Wednesday 20 December 2017

ফ্রিদরিশ্‌ নিৎশে অনুবাদ - গৌতম বসু



অনুবাদ কবিতা





এই কথা বলে গেলেন জ়ারাথুষ্ট্র


একটি বই, সকলের জন্য
এবং কাহারও জন্য নয়


জ়ারাথুষ্ট্র-র   প্রস্তাবনা
  

জ়ারাথুষ্ট্রর বয়স যখন ত্রিশ বছর, তিনি তখন তাঁর গৃহ ও গৃহ-সংলগ্ন হ্রদ ত্যাগ করে পার্বত্যপ্রদেশে চলে গিয়েছিলেন । সেখানে তিনি তাঁর চেতনার সঙ্গ ও একাকিত্ব উপভোগ করলেন, দশ বছরেও ক্লান্তি অনুভব করলেন না । অবশেষে, তাঁর চিত্তে পরিবর্তন এল  --  এক প্রত্যুষে, উদীয়মান সূর্যের উদ্ভাসের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তিনি বলে উঠলেন :
       ‘হে সুমহান তারকা, কী হত আপনার সুখের, যদি, যাদের জন্য আপনার ওই প্রজ্বলন,   এরা না থাকত ! বিগত দশ বছর, প্রত্যহ, আপনি  আমার  এই গুহা পর্যন্ত উঠে এসেছেন আমি না থাকলে, আমার এই ঈগল পক্ষী এবং আমার এই সর্প না থাকলে, আপনার আলোর বিপুল ভারেযাত্রার প্রাত্যহিকতায়, আপনি কত অবসন্ন বোধ করতেন, একবার ভাবুন।
       প্রতি প্রভাতে আমরা আপনার আগমনের জন্য প্রতীক্ষা করেছি, আপনার কাছে যা উদ্বৃত্ত , আমরা তা গ্রহণ করেছি  এবং তার জন্য দুহাত তুলে আপনাকে আমরা আশীর্বাদ করেছি ।
       প্রকাশ থাক, অর্জিত জ্ঞান আমার পক্ষে অবহ হয়ে পড়েছে, আমি যেন সেই মধুকর যে  প্রয়োজনের অতিরিক্ত মধু সংগ্রহ করে ফেলেছে : এখন আমার এমন উন্মুক্ত বাহুর প্রয়োজন, যে আমার সম্পদ গ্রহণ করতে সক্ষম ।
       অর্জিত সম্পদ আমি দান করতে, বিতরণ করে দিতে চাই, যত দিন, মানুষের মধ্যে যাঁরা প্রজ্ঞাবান তাঁরা আপন-আপন নির্বুদ্ধিতায় আবার সুখী না-হয়ে ওঠেন, আর দরিদ্র যাঁরা, তাঁরা সুখী না-হয়ে ওঠেন আপনআপন বৈভবে ।
       সেই উপলক্ষ্য আমার নেমে-আসা প্রয়োজন : যেমন আপনি করে থাকেন প্রত্যহ, দিনশেষে, সাগরের আড়ালে চলে যান, নেমে গিয়ে আলোকিত করে তোলেন, এমন কি  পাতালভুবনও, হে বিপুল ঐশ্বর্যময় তারকা !  
       আপনারই মতো  আমায় হতে হবে নিম্নগামী    --  যাদের কাছে আমি আজ পৌঁছতে চাই, তাদেরই ভাষা ব্যবহার করে বলি।
        অতএব, আশীর্বাদ করুন আমায়, হে প্রশান্ত চক্ষু, অফুরান সুখও যাঁর দৃশটিশক্তিকে ঈর্ষাবিদ্ধ করতে পারে না।
       আশীর্বাদ করুন এই পানপাত্র, যা সদাই উপচে পড়তে চায়; তরল সোনার মতো এই  জল, যা আপনার হর্ষের প্রতিবিম্ব ধারণ করে, তারে ছড়িয়ে দেয় বিশ্বময় !
        প্রত্যক্ষ করুন, সেই পানপাত্র আবার শূন্য হতে চায়, এবং জ়ারাথুষ্ট্র,আবার ফিরে পেতে চান তাঁর মানবজন্ম !’        
         এইভাবে আরম্ভ হল জ়ারাথুষ্ট্র-র অধোগমন  


  

পাহাড় থেকে একলা নেমে এলেন জ়ারাথুষ্ট্র ; পথে, কারুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল না । কিন্তু , অরণ্যে প্রবেশ করার সময়ে, অকস্মাৎ তিনি মুখোমুখি হলেন এক বৃদ্ধের, ফলমূলের সন্ধানে যিনি নিজের কুটির থেকে তখন বেরিয়ে এসেছিলেন। জ়ারাথুষ্ট্রকে দেখে সেই  বৃদ্ধ বললেন :
       ‘উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ানো এই ব্যক্তি আমার পূর্ব পরিচিত । বহু বছর পূর্বে, এই পথ দিয়েই হেঁটে গিয়েছিল সে। তার নাম ছিল জ়ারাথুষ্ট্র, কিন্তু, দেখছি, বিস্তর পরিবর্তন  হয়ে গেছে তার।
        তোমার ভস্মাবশেষ তুমি তখন পার্বত্যপ্রদেশে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলে ; আর আজ, তোমার আগুন তুমি কি তবে উপত্যকার দিকে  বহন করে নিয়ে চলেছ ! পরধনবিনষ্টকারীর উপযুক্ত শাস্তি পাবার ভয় হয় না তোমার ?
        হ্যাঁ, জ়ারাথুষ্ট্র-কে আমি চিনতে পারছি । তার দৃষ্টি স্বচ্ছ , অধরে ঘৃণার লেশমাত্র দেখছি না । নৃত্যশিল্পীর মতো নয় কি, তার চলন ?
       কত পরিবর্তন হয়েছে  জ়ারাথুষ্ট্র-এর! জ়ারাথুষ্ট্র এখন এক দিব্যশিশু, জেগে উঠেছে সে! নিদ্রিতদের মাঝে কী কাজ তোমার ?
       তুমি বাস করেছ অকূল নির্জনতায়, যেন-বা সাগরসলিলে একা ভাসমান, এবং  সাগরই তোমায় ধারণ করে এসেছে এতকাল। হায়, তুমিই এখন তীরে উঠে আসতে চাও ? হায়, নিজের শরীর তুমিই এখন টেনে-টেনে বয়ে বেড়াতে চাইছ ?’
        উত্তরে জ়ারাথুষ্ট্র বললেন, ‘আমি মানুষ ভালবাসি।
        ‘কেন’, লে চললেন প্রবীণ সন্ত, ‘আমি কি প্রথমেই অরণ্যের নিভৃতি বেছে নিই নি, বাস করি নি জনহীন মরুপ্রান্তরে ? তা কি কেবল মানুষের প্রতি আমার অকৃত্রিম ভালবাসার কারণে নয় ?
        আজ,আমি ঈশ্বরপ্রেমে মগ্ন : মানুষকে ভালবাসতে পারি না আর। মানুষ, আমার বিচারে, বড় অসম্পূর্ণ । মানুষকে ভালবাসতে গেলে আমি নিজেকে ধ্বংস  করে ফেলব।
        জ়ারাথুষ্ট্র উত্তর করলেন,‘মানুষকে ভালবাসার প্রসঙ্গ কেন তুললাম ? আজ আমি মানুষের জন্য উপহার নিয়ে এসেছি।
        ‘কিছু দিও না ওদের,’ সন্ত বললেন,‘বরং, ফিরিয়া নাও ওদের থেকে কিছু- কিছু , ভার যাতে লাঘব হয়, জীবনযাপন যাতে কিছুটা সহনীয় হয়ে উঠতে পারে। এতেই ওদের মঙ্গল, অবশ্য যদি তোমার পক্ষেও তা মঙ্গলজনক হয় ।
        কিছু যদি দিতেই হয়, ভিক্ষাদান করতে পারো ; কিন্তু দেখো, তারা যেন তোমার থেকে ভিক্ষা চেয়ে নেয়।’   
        ‘না’,বললেন জ়ারাথুষ্ট্র, ‘ভিক্ষা দিই না, আমি। অতটা গরীব হই নি এখনও।
        জ়ারাথুষ্ট্র-র কথায় সন্ত হেসে উঠলেন, বললেন, ‘দেখো, তোমার দেওয়া সামগ্রী  তারা  যেন গ্রহণ করে । সাধুসন্তদের তারা ঘোর সন্দেহের চোখে দেখে, আমরাও যে  কিছু দিতে সক্ষম, তা তাদের বিশ্বাসই হয় না ।
       তাদের বাসগৃহের আশেপাশের রাস্তায় আমাদের পদধ্বনি কেবলই ফাঁকা আওয়াজ তোলে । এবং রাত্রে বিছানায় শুয়ে, তারা যখন কান পেতে শোনে,  সূর্যোদয়ের পূর্বেই বাইরে কেউ হেঁটে যাচ্ছে , মনে-মনে তারা হয়তো ভাবে, “তস্করটা  চলল কোথায় ?”
       যেও না মনুষ্যসমাজে, এই অরণ্যেই রয়ে যাও । বরং, পশুপাখির জগতে প্রবেশ করো। আমার মতো কেন হয়ে উঠতে পারবে না তুমি  ---    ভল্লুকদের মধ্যে এক ভল্লুক, পাখিদের মধ্যে এক পাখি ?’
      ‘আর, সন্ত মহোদয়, এই ঘন জঙ্গলে আপনার কী করা হয় ?’, জিজ্ঞাসা করলেন জ়ারাথুষ্ট্র ।
       উত্তরে সন্ত বললেন, ‘আমি গীত রচনা করি, তারপর সে-গীত আমিই গাই । গীত রচনার সময়ে আমি কখনও উচ্চস্বরে হেসে উঠি, অশ্রুপাত করি কখনওকখনও, আবার  কখনও  আপন মনে বিড়বিড় করি : এই আমার ঈশ্বরবন্দনা !
         গান গাওয়ার ভিতর দিয়ে, কান্নার ভিতর দিয়ে, হর্ষোল্লাসের ভিতর দিয়ে, অর্থশূন্য বিড়বিড়ানির ভিতর দিয়ে, আমি সেই ঈশ্বরের জয়গান করি, যিনি আমার প্রাণের ঠাকুর। এবার বলো, কী তোমার উপহার ?’
       কথাগুলি শোনামাত্র সন্তকে শ্রদ্ধাপূর্বক অভিবাদন জানিয়ে জ়ারাথুষ্ট্র বললেন,‘ আপনাকে দেবার মতো কীই-বা আছে আমার ? এখন, আপনার থেকে কিছু গ্রহণ করবার  পূর্বেই এখান থেকে আমায় দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হতে হবে।এইভাবে, বালকদের  মতো খুশীমনে হাস্যপরিহাস করতে-করতে প্রবীণ সন্ত ও জ়ারাথুষ্ট্র পরস্পরের  থেকে বিদায় নিলেন।
       পরে, জ়ারাথুষ্ট্র যখন সম্পূর্ণ একা, অন্তস্তল তাঁর, লে উঠল, ‘বনবাসী বৃদ্ধ সন্ত অবহিতই নন যে ঈশ্বর তিরোহিত, এ কীভাবে সম্ভব হল!
 নিম্নগামী   লেখক এখানে একটি শব্দেরই  তিনটি ভিন্ন অর্থসঙ্কেত  নিয়ে রহস্য সৃষ্টি করেছেন, তিনটি অর্থই সমান্তরাল ভাবে প্রযোজ্য (ক) অধোগমন, (খ) সূর্যাস্ত এবং (গ) বিনাশ । শব্দার্থ নিয়ে খেলার এই রকম আরও নিদর্শন ছড়িয়ে  বইটিতে, যা  পাঠকের সুখ এবং অনুবাদকের দুঃস্বপ্নের কারণ হয়ে রইল ।

মানুষ  : লেখক কর্তৃক মানুষশব্দটি ব্যবহৃত হলেও অনেকে মনে করেন এর নিহিতার্থ মনুষ্যসমাজে সীমায়িত নয়পশুপাখির জগৎ  পর্যন্ত বিস্তৃত ।

•••

ফ্রিদরিশ্‌ উইলহেল্ম নিৎশে-র (১৮৪৪-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ)  Also Sprach Zarathustra’-তে ( Thus Spake Zarathustra’) নয়টি অংশে বিভক্ত একটি প্রস্তাবনার পর রয়েছে মূল গ্রন্থের  চারটি নাতিদীর্ঘ খণ্ড। প্রথম দুটি খণ্ড এবং তৃতীয় খণ্ডটি  প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৮৮৩ ও ১৮৮৪-তে ; তার পরের বছর,১৮৮৫-তে, চতুর্থ খণ্ডটি ঘরোয়াভাবে  মুদ্রিত হয় । বর্তমানের অনুবাদকর্মটি, অর্থাৎ প্রস্তাবনার প্রথম দুটি অংশ, এমন একজনের অক্ষম রূপান্তর, যার মূলভাষায় অক্ষরজ্ঞান নেই! অপটু অনুবাদের এই গর্হিত কাজটি করে ফেলার তবুও, একটি, মাত্র একটিই, কারণ হল, বইটির অপ্রতিরোধ্য কাব্যগুণ। এই বইটির সঙ্গে দীর্ঘকাল বসবাস করতে-করতে আমার মনে হয়েছে, দর্শনশাস্ত্রের আরও অনেক উত্তম পুথি, সন্দর্ভ, গ্রন্থ ও সঙ্কলন নিঃসন্দেহে আছে, কিন্তু, মহাকাব্যের পরিবারের বাইরে, এমন তীব্র ভাবাবেগমথিত দীর্ঘ কবিতা’, হয়তো, আর একটিও নেই ! অর্বাচীন পাঠকের দিকে এগিয়ে আসতে-আসতে এই কথা বলে গেলেন জ়ারাথুষ্ট্রএক সময়ে একটি বাঙলা বই হয়ে উঠতে চায় !
       ‘মহামানব’,‘ঈশ্বরের মৃত্যুসংবাদ ঘোষণাপ্রভৃতি বিবিধ উক্তি-বিষয়ে এত ব্যাখ্যা, এত অপব্যাখ্যা ও এত,এত অতিব্যাখ্যা অন্য কোনও দুর্ভাগা বইয়ের কপালে জুটেছে  কি না তা-ও ভেবে দেখবার এক প্রসঙ্গ । এই বই প্রকৃতপক্ষে ছায়ামূর্তিদের; এখানে কখনও  শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধ-র, কখনও তলস্তয়এর, আবার কখনও  শোপেনহাওয়ার-এর কিম্বা ওয়াগ্‌নার-এর  ছায়ামূর্তির পদচারণ টের পাওয়া যায়, আর প্রতি পৃষ্ঠায় রয়েছে  জ়ারাথুষ্ট্র-বেশী স্বয়ং নিৎশে-র ছায়া !
                                                   
ঋণস্বীকার : ১. আর. জে. হলিংডেল-কৃত ইংরেজি অনুবাদ (পেঙ্গুইন,১৯৬১/৬৯) ২. এড্রিয়ান  ডেল কারো-কৃত ইংরেজি অনুবাদ (কেম্ব্রিজ ইয়ুনিভারসিটি প্রেস,২০০৬), ৩. ১৯১০-এর টমাস কমন-এর ইংরেজি অনুবাদের ভিত্তিতে প্রস্তুত উলিয়ম এ. চাপ্‌কো-র ইংরেজি অনুবাদ(২০১০)৪.কস্মোপলিটান ভিউ অফ্‌ নিৎশে’ – আনন্দ কেন্টিশ কুমারাস্বামী  এবং ৫.  Avesta – Zoroastrian Archives (https://www.avesta.org)

No comments:

Post a Comment