সার্ন-সাহিত্য – ভবিষ্যতের
আলো
গদ্যকে কাব্যিক করে তোলা
হচ্ছে। অনু, পরমানু
ইলেক্ট্রন, প্রোটন,
বোসনে ভাগ করা হচ্ছে। একদিন এক সাহিত্যিক বললেন 'কঃ'। কিছুই বুঝলাম না। জিগ্যেস করায় বললো,
"বুঝে নাও। তুমি যেমন ভাববে,
তেমনই।" আমি হাতে ধরলাম,
পায়ে ধরলাম, কাকুতি মিনতি করলাম, কিছু না বুঝতে পারলে আমার পেট গুড়গুড় করে তাও বললাম,
ফল হল না । শেষে দুদিনের মত য়্যান্টাসিড কিনে
বাড়ি ফিরে ভাবতে বসলাম 'কঃ
কেন কইলো'।
প্রথমে ভাবলাম শুধু ক বললেও
একটা কথা ছিল। অনু পরমাণু মাইক্রাণু হতে হতে হয়ত ভবিষ্যতে কোনদিন শুধুমাত্র একটি
অক্ষরে এসে থামাবে বাংলা সাহিত্যকে। ভাবেন, অত্ত বড় রচনাবলী মাত্র একটা অক্ষরে। সেদিন বিজ্ঞাপনে দেখলাম
অতবড় মহাবলী চালিশা মাত্র একটা হোমিওপ্যাথির বড়ির মধ্যে,
তবে রচনাবলীই বা একটা অক্ষরে ঢোকানো যাবে না কেন।
দেখা গেল বিশিষ্ট সাহিত্যিককে সন্মান দেওয়া হচ্ছে, "...জ্ঞানপীঠ অমুক মহামহোপাধ্যায় বাবু আজ আমাদের
মধ্যে উপস্থিত আছেন। ওনাকে তার বিখ্যাত বই 'ক' রচনার
জন্যে যে পুরস্কারে বিভূষিত করা হয়েছে, বাঙালি হিসেবে তিনি আমাদের মুখ উজ্বল করেছেন... তার আলোয়
আলোকিত হয়ে উঠুক আমাদের বঙ্গসাহিত্যজগত... আজ তার করকমলে তুলে দিচ্ছি আমরা... এবার
তিনি আপনাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন... এই মাইকম্যান, মাইকটা ওনার হাতে দাও।" সাহিত্যিকবাবু উঠে
দাঁড়ালেন, জনগণের মধ্যে থেকে একটা
শোরগোল পড়ে গেল। তিনি মাইকটি হাতে নিয়ে স্মিত হাসলেন,
দর্শকদের দিকে তাকালেন এবং একটি দীর্ঘশ্বাস
ছাড়লেন, মাইকে ফ্যাঁসসসস করে আওয়াজ
হল। জনগণের মধ্যে থেকে করতালিধ্বনি উঠল। মাইক্রোফোনটা আবার ফেরৎ গেল উপস্থাপকের
কাছে, "অপূর্ব অপূর্ব,
ভাষাতীত তার ভাষণ, এই অপূর্ব ভাষার আবির্ভাবক হিসাবে তিনি শুধু
রাজ্যের নয়, দেশের
মুখ উজ্বল করুন, পৃথিবীর
মুখ উজ্বল করুন, এই
সৌরজগতের মুখ উজ্বল করুন..."
এমন না হওয়ার কোন কারণ আজ
খুঁজে পাচ্ছি না। হবে না বলে কোনও কথা নেই দাদি (দাদা ও দিদিদের সমানাধিকারের যুগ,
আবার কেও 'দিদা' হল না কেন বলে ঠোঁট বেঁকাবেন না,
ওই নাম আগে থেকেই বুক হয়ে আছে)। ওই সাহিত্যিক
ভদ্রলোক হয়তো তার সাহিত্যের সঙ্গে সময় যোগ করেছেন। তিনি কেন ভোরের বেলায় 'ক' না বলে সকালে বললেন, তা অতি ভাবনার বিষয়। এছাড়াও কি বোধে 'ক' পড়তে হবে, সে সম্পর্কে ধারণা থাকারও বিশেষ প্রয়োজন। নিজের বোধশক্তিকে
মাত্রা দিতে হবে, দ্বিমাত্রিক,
ত্রিমাত্রিক এবং চতুর্মাত্রিকও। ধরা যাক
দ্বিমাত্রিক বোধে আপনি 'ক'
পড়ছেন। এক্ষেত্রে আপনার ভাবনাকে দ্বিমুখী করতে
হবে। এই ব্যবহার আগেও লক্ষ্য করা গেছে ভারতবাবুর অন্নদামঙ্গলে,
অর্থাৎ কিনা যার নাম হয়েছে দ্যর্থক। আপনারা সবাই
জানেন এই ব্যবহার। অন্নদামঙ্গল অনেক বড় কাব্যগ্রন্থ। দিনে দিনে আরও অনেক কাব্যের
মত আধুনিক যুগে এসে কাব্য পরমানু হয়েছে। সে এক সুদীর্ঘ পথ,
অনেক বিস্তার, ব্যপ্তি। ধরনেও বেড়েছে, এখন আর দুটো অর্থ বহন করে না, চারটে, পাঁচটা... অগুনতি। সে সময়কার বড় বড় পন্ডিতেরা আজকের দিনে
তার নাম হয়ত দিতেন 'দুই
টু দি পাওয়ার ইনফিনিটির্থক'।
এবার আসলো ত্রিমাত্রিক
বোধবাচক 'ক'। যেখানে যুক্ত হবে ভাব। অর্থাৎ নানা অর্থ
পরিবহনকারী 'ক'এর সাথে ভাবমাত্রা যোগ দেবে। যেখানে কেও কেমন
সুরে ‘ক’-কে পড়ছে, উচ্চারণ করছে, করাচ্ছে, করাতে বাধ্য করছে, ব্যঙ্গ করছে ইত্যাদি
ইত্যাদি। সে সবে পরে আসছি। আপাতত উচ্চারণ। কন্ঠস্বরের নানাবিধ ব্যবহারে ‘ক’ পড়া
যেতে পারে। কিশোরর কুমারের হুডলিঙের মতো করে ‘ক’ পড়া যেতে পারে। করে দেখুন,
কোকিলের মতো আওয়াজ হবে। অর্থাৎ কিনা বসন্তকাল। বসন্তকালকে ছোটরা যতই আজকাল ফিল না
করুক, গল্পেকথায় তাদেরও মনে আসতে বাধ্য একটা পর্ণমোচী বিকেল, না শীত না গরম, হাফ
সোয়েটার, তলে কলার দেওয়া জামা অথবা পোলো টি, ভ্যালেন্টাইন সারস্বত্যত্তর খুশি খুশি
মরসুম। অর্থাৎ কিনা প্রেমের আবহাওয়া। সুতরাং একে বলা যেতে পারে প্রেমবাচক ‘ক’।
সেদিক থেকে সাহিত্যিক প্রেমিকসুলভ। একটু বয়স্করা অবশ্য অমন ভাবে ভাববেন না।
বসন্তকাল এলে তাদের বেশিরভাগের সঙ্গে বৎসরান্তর পকেট লঘুকরণ চলে। কেন ট্যাক্স এমন
কাটা হল, এর উপায় কি, এল.আই.সি. পলিসি কত্ত কি। এ এমন এক ‘ক’ যার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক
অবস্থা ফুটে উঠছে। এখানে সাহিত্যিক কিন্তু সাম্যবাদী। অতি বয়স্কদের অবশ্য
ট্যাক্সের ঝামেলা নেই, দেহে মনে প্রেম নেই, গতরে শক্তি নেই, সংসারে ভক্তি নেই, নেই
নেই কিছু নেই তবুও তো আছে কিছু বলতে যা বাধা নেই। তাই ‘ক’ আছে। কোকিলের ‘ক’ হোক বা
প্যাঁচার ‘চ’, এনাদের কাছে বসন্ত-শরৎ সব সমান। তাঁদের কাছে কিছুই আর রইলো না, সব
নষ্ট, ছারখার হয়ে গেল। কোথায় আর সে বসন্ত হে হরিহর, সে এক আমল ছিলো, যখন বনে বনে
কোকিল ডাকত, লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম হত, দুনয়নে কথা হত, মনে সংশয় হত। এখন আর কিছুই
নেই। এখানে ‘ক’ প্রতিবাদের ভাষা ব্যবহার করছে। অর্থাৎ সাহিত্যিক প্রতিবাদী। এমন
অনেক ভাগেই ভাগ করা যেতে পারে। কারোর ইচ্ছে হলে প্রয়োগ করবেন, না পারেন তো আমাকে
মেসেজ করবেন, বুঝিয়ে দেবো।
এ তো গেল ত্রিমাত্রিক।
দাঁড়ান দাদা, চতুর্মাত্রিকও আছে। আমার এই সাহিত্যিক দাদাটি একসময় কবি ছিলেন। তাঁকে
আমি রবীন্দ্রনাথ বলি। বহুমুখী তাঁর প্রতিভা। কবিতাকে ছোট আর বোধযুক্ত করতে করতে
যখন দেখলেন যে আর ছোট হচ্ছে না, বা এরচে’ বেশি ছোট হলে লোকে ধরে মানসিক হাসপাতালে
পুরে দেবে, তখন তিনি মন দিলেন গদ্যে। পড়ে ফেললেন মোটা মোটা যত বঙ্কিমী থেকে হর্ষী।
মন দিলে লঘুকরণে। ছোটগল্প অবধি রবীন্দ্রনাথে করে গেছেন, পরমাণু অবধি আধুনিক, কেও
একজন, বা কোনও দল। ইনি আরও তলে ঢুকেছেন, এবং তারও তলে ঢোকার চেষ্টা করছেন অতল ও
অটল ভাবনা নিয়ে। মাঝে মাঝে তিনি বলে ফেলেন যে তিনি বোসন্স-হিগিন্স খুঁজে পেয়েছেন,
কিন্তু পরিস্কার করে কাশেন না। মনে হয় এবার ‘ক’-এর পাশে ‘ব’-এর বাংলা ১ মার্কা
ডান্ডাটাকে লিখলেই হয়ে যাবে। পুরো ‘ব’-টাকে লিখতেই হবে না আর। যাক সেটা অনেক পরের
ভাবনা। এখনও উনি রত আছেন এবং আমিও নিশ্চিত নই যে তা হবেই কিনা। এটা আমার ধারণামাত্র।
যাই হোক চতুর্মাত্রিক
বোধবাচক ‘ক’-এর মধ্যে যোগ হচ্ছে সময়। এখানে উনি কোন সময়ে বসে ‘ক’-টি লিখেছেন।
ভোরে, দুপুরে, সন্ধ্যেতে, না রাতে। আসা যাক সেই বসন্তকালেই। কিশোরকুমারের
হুডলিংবাচক সেই ‘ক’, তাতে আপনারা রিলেট করতে পারবেন। সাহিত্যিক দুপুরবেলায় অমন
সুরে ‘ক’ গাইলেন। বয়স্কদের অনুভুতি এলো বসন্তদুপুরোবেলা বারো ভুতে মারে ঢেলা,
বাড়ির টিনের চালে দৌপ্রাহরিক ঢিল, অতিষ্টের একশেষ। বিচ্ছিরি মুখ, রাগে ভেজা শরীর।
যুদ্ধবাদী সাহিত্য। অপরদিকে সুখের দুপুর, আরামের নিদ্রা। এটি অবশ্য যারা চল্লিশের
কোঠায়, তাদের আসে। তাদের কাছে একটি চতুর্মাত্রিক বাসন্তী ‘ক’ হল অস্তমিত হওয়ার
প্রতীক। এখানে কিন্তু সাহিত্যিক পড়ন্ত যৌবনের কথা ব্যক্ত করেন। আমার দুই
দাদাস্থানীয় বন্ধু আছেন, সবারই আছে। বিশ্বাস না হয় তাদের থেকে শুনে নেবেন বয়স
অনুপাতে।
এছাড়াও আপনি একটা কিউবের মত
এই পুরো ব্যাপারটিকে কল্পনা করতে পারেন, এবং কিউবটির সবকটি পয়েন্ট থেকে পয়েন্টে
সরলরেখা টানতে পারেন, যার প্রতিটা পয়েন্ট প্রতিটা পয়েন্টকে যুক্ত করছে। 3ডি
ম্যাট্রিক্সের কল্পনা করে আপনি এটাকে মাঝে মাঝে গরমকালের দুপুরে ‘ট’ শুনতে কেমন
লাগবে, বা শীতকালের রাতে ‘ম’ শুনতে কেমন লাগবে – এভাবেও ভেবে নিতে পারেন। আমি
লিখতে গেলে গোটা একটা থীসিস হয়ে যাবে। ওনার নোবেলে আমি হাত দিতে চাই না। যদি চান
তবে তাঁর বাড়িতে গিয়েও শুনে আসতে পারেন, নিজে ভেবে নিতে পারেন, অন্যকে সেই ভাবনা
ব্যাক্ত করতে পারেন, সভা জনসমাগম করতে পারেন, বই লিখতে পারেন, মীরাক্কেলে যেতে
পারেন, রাজকবি হতে পারেন – নানাবিধ কাজ করতে পারেন। অপার স্মিতহাস্যমুখে মাঝে মাঝে
উচ্চারণ করতে পারেন। কোন সময়ে তা উচ্চারিত বা লিখিত হচ্ছে তা বোঝার জন্য আপনার
পাশে নিশ্চিত কিছু করুণাপ্রার্থীরা বসে থাকবেন ও আপনার উচ্চারণের বোধবিবেচনা করবেন
দিবারাত্র। আপাতত উনি যেহেতু এই ব্রতে রতী আছেন, তাই আমি বিরতি নিলাম।
এটুকু ভাবতেই রাত কাবার হয়ে
গেলো। পরের দিন সকালে ভাবলাম তাহলে বিসর্গটা দেওয়ার অর্থ কি? আমি পষ্ট বিসর্গের
আওয়াজ শুনেছি। আবার চিন্তায় বসলাম। ‘যা’ শব্দের সঙ্গে বিসর্গ বসালে যাঃ হয়। যা আর
যাঃ-এর পার্থক্য কি? এই যে আমি আমার রুমমেটটার যখন খাবার আনতে যাওয়ার দিন পড়ে, তখন
আমি বার বার বলি – যা। একটু পরে বলি – যাআআ। শেষে অনেক্ষণ বাদে বৌদিকে ফোন করে যখন
শুনি বৌদি শুয়ে পড়েছে তখন ‘যাঃ’। সুতরাং বিসর্গও অর্থ বহন করে। কিন্তু কি যে অর্থ,
তা ভাবার তখন আর সময় ছিলো না। পেটে য়্যাসিড ক্রমাগত বাড়ছে, মুখটা তেতো হয়ে উঠছে।
এরপর হলে ভদ্রলোককে অন্যমনষ্ক যাতে না হতে হয়, তার ব্যাবস্থা করতে ‘কঃ’-এর
ব্যাখ্যা শুনতে সকালেই চললাম তার বাড়ি।
গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি বললেন,
‘জানিস, কাল দুপুরে ইলিশমাছ খেতে গিয়ে গলায় একটা কাঁটা ফুটেছিলো, বেরোচ্ছিলো না।
কথাও বলতে পারছিলাম না। একটু আগে বেরোলো। বল, কাল কেন এসেছিলি?”
No comments:
Post a Comment