Monday 18 December 2017

অ র্ণ ব চৌ ধু রী

গদ্য


অ র্ণ ব   চৌ ধু রী 

আড়াল সরিয়ে দেখি






অনেক অনেক গভীরে, বুঝতে পারি আবছা অন্ধকারে বোধহয় একটা জলাশয় আছে ; আছে তার নিজস্ব নিয়ম। আর সেই নিজস্ব ছন্দের জলকল্লোল আমি শুনতে পাই, তার খোঁজ শুরু করি। তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় এই খোঁজ।  বুঝি এখুনি একটা বিদ্যুৎ উন্মোচিত হয়ে উঠবে ওই মাটিতে। মগ্নচৈতন্যে মিশে যাবে আলো-জল- মাটি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্য স্বীকারোক্তি, উচ্ছৃঙ্খলতা,নৈরাজ্য, বিপ্লব, বিপ্লবের হতাশা, নারীবাদ, চূড়ান্ত মানবিকতা, বিশ্বায়ণের বাজারে উন্মুক্তি, ইত্যাদি  পেরিয়ে গতো দশবছরে এসে পৌঁছেছে একধরণের আধুনিক আত্মকেন্দ্রিকতায়। সমস্ত আধার পেরিয়ে এইযে আধেয় কে না জেনেই অস্বীকার করার এক প্রবণতা, তা ধীরে ধীরে তৈরী হয়েছে। অসাধারণ চমকপ্রিয়তা জলাশয় ভরিয়ে তুলেছে। আলোর উৎসবে কোনও পথ-ই কী নির্দিষ্ট করতে পারা যায় এখন?


এসব ভাবতে ভাবতে আবার শীত নেমে আসলো, জানলা খুলে দিলেই দেখা যাচ্ছে ধূ ধূ কুয়াশার অন্ধকার আলো গ্রাস করতে এগিয়ে চলেছে। এর মধ্যেই কোথাও বেজে ওঠে 'ক্রীসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ ', 'জলপাই কাঠের এসরাজ ', দেখা যাচ্ছে 'আলো', 'কলম্বাসের জাহাজ' কিংবা অধুনা অতীতের 'জল রঙের কবিতা, 'ভেতর মনের দরবেশ' অথবা 'যাদুকর অন্ধফেরিওলা' , রাত যতো গভীর হয় উঠে আসে 'রাত্রি চতুর্দশী', আর একেকটি বিষাদ শিবির আয়োজন করে জলাশয়ের খোঁজ করতে আমিও রাত্রিচর- বুনোচাঁদ হয়ে বেড়িয়ে পরি আমার নিজস্ব মহাকাশে।

ঘন সংঘবদ্ধ, আধুনিকতার সংহতি কাব্য-শিল্পেকে বদ্ধ করে রেখেছে বলেই আজ বারবার  মনে হয়। এদেশের পটভূমিতে রচিত আত্মমগ্ন কবিতার যে ধারা তা শিখরে পৌঁছবার আগেই ভেঙে পড়েছিল ৩০ দশকে। অসাধারণ প্রজ্ঞায় ৩০ এর কবিরা অস্বীকার করেছিল সেই রোম্যান্টিক চেতনাকে। পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫০ এর আত্মকেন্দ্রিক কবিতা তাকে পৌঁছেদিল উচ্চিতার শিখরে। ধীরে ধীরে বাংলা কবিতায় যে আধুনিক ভঙ্গী প্রতিষ্ঠিত তা এক অন্ধ অনুকরণের ফসল । প্রশ্ন করি নিজেকে এখন আর এ যুগের শিল্পের পটভূমি তৈরি করতে পারবে ?

৪০ দশক থেকে উঠে আসা সামাজিক কবিতা, কিংবা ৭০ এর একটা অংশে যে সামাজিক বেদনানির্ভার কাব্যশিল্প ধারা তাও কী ফিকে হয়ে আসছে না? অথচ শিল্প সাহিত্যের ইতিহাস কখনওই সামাজিক ইতিহাস দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না। কারণ সাপ যেমন প্রকৃতির নিয়মেই তার খোলস ছেড়ে যায়, কিংবা উদ্ভ্রান্ত শীতেও বসন্ত উৎসব কে যেমন আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না, ঠিক তেমনই শিল্পের ইতিহাসে আজ এই আপাত কঠিন অথচ স্বচ্ছ আড়ালটিকে চিহ্নিত করে সরিয়ে দেবার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে বলেই মনে করি। এই আত্মকেন্দ্রিক অথচ পাঠক নির্ভর কবিতার চেয়ে আজ আরও বেশি জোর দিতে চাই কল্পনা সঞ্জাত আনন্দকে। আমার আত্মার নির্বোধ বিলাস-কে। মনে পড়ে জার্মান রোম্যান্টিক কবিতার জনক নোভালিস বলেছিলেন 'জীবন হল চৈতিন্যের পীড়া',। আর এই গভীর থেকে গভীরতম পীড়ার খোঁজ করতে নিজেকে 'সুদূরের পিয়াসী ' বলার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে বারবার। রবীন্দ্রনাথ সততই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, নদীর নিজস্ব গতিপথ বদলের কথা, আর তাঁর মতে এই প্রত্যেকটি গতিপথ বদলের সাথে সাথে নদীর পার ভাঙতে হয়, নির্মান করতে হয় নতুন পার। আর এই নতুন পারেই তৈরি হয় নতুন সংস্কৃতি। তবে নদীর কোনও গন্তব্য থাকে না, থাকে শুধু বাঁকবদল। তাই একেকটি দিক, নদীর গন্তব্য হিসাবেই উঠে আসে।

এসব ভাবতে ভাবতে রাস্তায় বেরই। চেনা রাস্তাটাকে অচেনা নদীর মতন মনে হয়। মনে হয় এই বিশাল কালো জলের সমাহার, কল্পনার এক গভীর স্রোতে আমাকেই আলো নিয়ে এসে নিজের পথ পরিষ্কার করে নিতে হবে। তীব্র আলো। প্রেমিকার নাভির মত নরম অথচ চোখের মত সুতীব্র। তবে প্রশ্ন জাগে এইই আলো কী জ্ঞান? যথার্থ ব্রহ্ম? চোখ ঝাপসা করে দেয়না?  তা নাহলে আত্মজ্ঞান দ্বারা তো তাঁকে ধরাই যায় না। তবে আত্মকেন্দ্রিক ভাবনা সেই আত্মজ্ঞানকেই প্রাধান্য দেয়,। আরও বেশি জোরালো করে আমাদের আত্মমৈথুন। যা আলো থেকে ক্রমাগত দূরে রেখে আমার চোখের সামনে নিয়ে এসে ধরছে চমক প্রিয়তা। যে চমকে চালাকি আছে প্রতিভা নেই, প্রতিভা থাকলেও তাতে অনুভূতি নেই, নিজের স্বপক্ষ তারা বলেন 'এই হচ্ছে চিরকালীন, এই হচ্ছে বাতিল, এই হচ্ছে বর্তমানের নতুন ' ইত্যাদি। কিন্তু কী নতুন? শিল্পের নিজস্ব একটা ইতিহাস আছে, সেখানে না আছে এগিয়ে যাওয়া, না আছে ইতিহাসগত ভাবে পিছিয়ে যাওয়া। না আছে গাছের ওপরে উঠে আলো পাওয়া না আছে ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে আলো মেখে নেওয়া। বরং শুধু  আছে বিকেলের ধূসর আলো, সে যেমন প্রতিটি গেরস্থালীতে অবলীলায় মিশে যায় আবছায়ার মতন, ঠিক তেমনই আছে মিশে যাওয়া। পাতার শরীরে শরীরে মিশে আলোর সঞ্চয়, কিংবা মাটির গভীর থেকে উত্তাপ। আর এই প্রক্রিয়াতেই যথার্থ কল্পনাপ্রতিভা, কল্পনালতার মত নিজের ভিতরে লালন করতে ইচ্ছে হয়। একটা বিরাট আড়াল সরিয়ে, নিজেকে বিশাল এক চাদরে ঢেকে দিতে ইচ্ছে হয়। যাতে পথের বাঁক শুধু নয়, বাঁকের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কীটাণুকীটেরা আমাকে গোপনে আক্রমণ করতে কোনও কোলাহলের সম্মুখীন না হ। কারণ কখনো কখনো পথ নিজেই তার যথার্থ পথিক কে বেছে নেয়।


No comments:

Post a Comment