তর্পণ
অ র্ণ ব সা হা
গিলোটিনের নীচে জীবন
রবিশংকর বল ছিলেন ভীষণভাবে নিটশে-পন্থী । কোনো সমষ্টিগত প্রত্যয়, সামূহিক
বিপ্লবের পবিত্র সম্ভাবনায় তাঁর বিশ্বাস ছিল না । কোনো মার্কসবাদী ‘ইউটোপিয়া’ নয়,
যেন-বা এক অনিশ্চিত অথচ অমোঘ ‘ডিসটোপিয়া’-র
দিকেই ছিল তাঁর ঝোঁক । তাঁর
‘মণিময়’ কোনো সমষ্টির একক নয়, সে এক কিনারবাসী নিঃসঙ্গ মানুষ, যার ডায়েরিতে কোনো
এন্ট্রি-ডেট থাকে না । কারণ, রবিশংকর বল জানতেন, যুক্তি এবং প্রগতির একরৈখিক
পরাক্রমকেই জীবনের কেন্দ্রস্থল বলে ধরে নিয়েছিল যে ‘আধুনিকতা’, সেই ‘বদ্ধ’,
উত্থানপতন-সর্বস্ব স্থুল ঘটনা-পরম্পরার বাইরে, জীবনের ‘মার্জিন’ থেকেই উঠে আসবে
আজকের আখ্যান । পরিত্যক্ত ফুটনোটের মধ্য থেকেই জন্ম নেবে ভাষা-পৃথিবীর এক
পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা, যে নৈরাজ্য একক ব্যক্তি-মানুষকে ঠেলে দেবে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের
দিকে । একলা মানুষের হৃদয়ে জন্ম নেয় যে অনিশ্চয়তা, যে অনিকেত বোধ তাই আসলে গড়ে
তোলে এক অনিবার্য লিখনপরিক্রমা—সাম্প্রতিক বাংলা গদ্যে সেই বিপন্নতার শিল্পরূপ
ফুটিয়ে তুলতে পারার মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন রবিশংকর । ‘স্বপ্নযুগ’, ‘মধ্যরাত্রির
জীবনী’, ‘বাসস্টপে একদিন’, ‘স্মৃতি ও স্বপ্নের বন্দর’, ‘ছায়াপুতুলের খেলা’ থেকে
‘দোজখনামা’, আয়নাজীবন’, ‘ধুলোবালিকথা’ থেকে গত বছর ‘নরকে এক ঋতু’ অব্দি সেই
পরিক্রমা জারি রেখেছিলেন তিনি ।
রবিদার সঙ্গে আমার আলাপ ২০০৪ সালে । বইমেলার মাঠে একা হেঁটে-যাওয়া রবিদার
হাতে আমাদের সম্পাদিত ‘মন্তাজ’ পত্রিকার দুটি সংখ্যা তুলে দিই আমি । এরপর ঘনিষ্ঠতা
আর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ২০১০-এর পর । যেহেতু আমি বাংলা লেখালেখিতে শুরু থেকেই
দাদা-বিহীন একক জার্নির দিকে এগিয়েছি, রবিদার সঙ্গে আমার ফ্রিকোয়েন্সি মিলে যায়
এবং ক্রমশ রবিদার একক, বিপজ্জনক জীবনচারণার গূঢ় রহস্যের পরতগুলো আমি আবিষ্কার করতে
থাকি তার লেখা ও মানুষ রবি-র মিশেলে । টের পাই ‘বাসস্টপে একদিন’-এর সেই একটু একটু
করে অন্ধ-হয়ে-যেতে থাকা লোকটা, মণিময়, ‘ধুলোবালিকথা’-র সেই একাকী নায়ক থেকে শুরু
থেকে মান্টো-গালিব অব্দি সকলেই আসলে ব্যক্তি-রবিশংকরেরই সম্প্রসারণ । এক ঘাতক
প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন তিনি । সেই মারণ-প্রতিভাই, তার প্রাণসংহার করেছে শেষ
পর্যন্ত ।
অজর অমর অধ্যাপকগণ তাঁর গদ্যের মাংস-কৃমি খুঁটে ভোজসভার উল্লাসে মেতে উঠবেন
হয়তো । আমি শুধু দেখতে পাব, চেতলার অলি-গলি পেরিয়ে একলা রাস্তা হাঁটছেন, ওই তো
মণিময়, তার কাহন...
অনবদ্য
ReplyDelete