Wednesday 20 December 2017

তর্পণ


তর্পণ












অ র্ণ ব সা হা

                                                                      

গিলোটিনের নীচে জীবন

 রবিশংকর বল ছিলেন ভীষণভাবে নিটশে-পন্থী । কোনো সমষ্টিগত প্রত্যয়, সামূহিক বিপ্লবের পবিত্র সম্ভাবনায় তাঁর বিশ্বাস ছিল না । কোনো মার্কসবাদী ‘ইউটোপিয়া’ নয়, যেন-বা এক অনিশ্চিত অথচ অমোঘ ‘ডিসটোপিয়া’-র  দিকেই  ছিল তাঁর ঝোঁক । তাঁর ‘মণিময়’ কোনো সমষ্টির একক নয়, সে এক কিনারবাসী নিঃসঙ্গ মানুষ, যার ডায়েরিতে কোনো এন্ট্রি-ডেট থাকে না । কারণ, রবিশংকর বল জানতেন, যুক্তি এবং প্রগতির একরৈখিক পরাক্রমকেই জীবনের কেন্দ্রস্থল বলে ধরে নিয়েছিল যে ‘আধুনিকতা’, সেই ‘বদ্ধ’, উত্থানপতন-সর্বস্ব স্থুল ঘটনা-পরম্পরার বাইরে, জীবনের ‘মার্জিন’ থেকেই উঠে আসবে আজকের আখ্যান । পরিত্যক্ত ফুটনোটের মধ্য থেকেই জন্ম নেবে ভাষা-পৃথিবীর এক পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা, যে নৈরাজ্য একক ব্যক্তি-মানুষকে ঠেলে দেবে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দিকে । একলা মানুষের হৃদয়ে জন্ম নেয় যে অনিশ্চয়তা, যে অনিকেত বোধ তাই আসলে গড়ে তোলে এক অনিবার্য লিখনপরিক্রমা—সাম্প্রতিক বাংলা গদ্যে সেই বিপন্নতার শিল্পরূপ ফুটিয়ে তুলতে পারার মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন রবিশংকর । ‘স্বপ্নযুগ’, ‘মধ্যরাত্রির জীবনী’, ‘বাসস্টপে একদিন’, ‘স্মৃতি ও স্বপ্নের বন্দর’, ‘ছায়াপুতুলের খেলা’ থেকে ‘দোজখনামা’, আয়নাজীবন’, ‘ধুলোবালিকথা’ থেকে গত বছর ‘নরকে এক ঋতু’ অব্দি সেই পরিক্রমা জারি রেখেছিলেন তিনি ।

রবিদার সঙ্গে আমার আলাপ ২০০৪ সালে । বইমেলার মাঠে একা হেঁটে-যাওয়া রবিদার হাতে আমাদের সম্পাদিত ‘মন্তাজ’ পত্রিকার দুটি সংখ্যা তুলে দিই আমি । এরপর ঘনিষ্ঠতা আর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ২০১০-এর পর । যেহেতু আমি বাংলা লেখালেখিতে শুরু থেকেই দাদা-বিহীন একক জার্নির দিকে এগিয়েছি, রবিদার সঙ্গে আমার ফ্রিকোয়েন্সি মিলে যায় এবং ক্রমশ রবিদার একক, বিপজ্জনক জীবনচারণার গূঢ় রহস্যের পরতগুলো আমি আবিষ্কার করতে থাকি তার লেখা ও মানুষ রবি-র মিশেলে । টের পাই ‘বাসস্টপে একদিন’-এর সেই একটু একটু করে অন্ধ-হয়ে-যেতে থাকা লোকটা, মণিময়, ‘ধুলোবালিকথা’-র সেই একাকী নায়ক থেকে শুরু থেকে মান্টো-গালিব অব্দি সকলেই আসলে ব্যক্তি-রবিশংকরেরই সম্প্রসারণ । এক ঘাতক প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন তিনি । সেই মারণ-প্রতিভাই, তার প্রাণসংহার করেছে শেষ পর্যন্ত ।

অজর অমর অধ্যাপকগণ তাঁর গদ্যের মাংস-কৃমি খুঁটে ভোজসভার উল্লাসে মেতে উঠবেন হয়তো । আমি শুধু দেখতে পাব, চেতলার অলি-গলি পেরিয়ে একলা রাস্তা হাঁটছেন, ওই তো মণিময়, তার কাহন...

                                                                   


1 comment: