Thursday 21 December 2017

ক ণি ষ্ক ভ ট্টা চা র্য

ধারাবাহিক গদ্য






                                    
                             
                              
                             জানলা



উড়ন্ত ধুলোও রেখা হয়ে যায়। কাঠের স্কেলটার সরু দিকটা চোখের কাছে তুললে যেমন সরু হয় তেমন সরু রেখা। ধুলোর রেখা। উড়ন্ত ধুলোর রেখা কাঠের জানলার ফাঁক থেকে মেঝে অবধি নামে স্কেলে টানা লাইনের মতো। মেঝেতে শুয়ে শুয়ে শুয়ে ওই আলোর রেখার দিকে তাকিয়ে থাকলে দেখা যায় ওর মধ্যে ধুলোর কণাগুলো উড়ে উড়ে বেড়ায়। ঘরের ভিতরের হাওয়ার সঙ্গে একই দিকে যায় ধুলোগুলো। শুধু ওই আলোর রেখা থেকে বেরিয়ে গেলে ওগুলোকে আর দেখা যায় না।
কাঠের খড়খড়ি দেওয়া জানলা। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে তাকালে দেখা যায় চিল উড়ছে আকাশে গোল হয়ে। চিলের ডাক খুব তীক্ষ্ণ। চিল নাকি অত ওপর থেকে সব দেখতে পায়। আচ্ছা, এই জানলাটা দেখতে পায়। জানলার ভিতরে ছেলেটা যে দাঁড়িয়ে আছে ওকে দেখতে পাচ্ছে চিল গুলো? এই জানলাটা দেখতে সবুজ রং ছিল আগে। জায়গায় জায়গায় সেই রং উঠে গেছে আবার খড়খড়ি এক জায়গায় সেই রঙে হাতের ছাপ পড়তে পড়তে কালো হয়ে গেছে। অনেক কালের জানলা ওই পাশের বাড়ির বুড়োর মতো বুড়ো হয়ে গেছেতাই কাঠের খাঁজের মাপ বোধহয় গুলিয়ে যায় ওর। বর্ষাকালে ‘মার টান-মার টান’ করে আটকাতে হয়। আবার গ্রীষ্মকালে এইরকম নানা ফাঁক দিয়ে আলোর স্কেল পাশ ফিরে নেমে আসে।
তখন গরমের ছুটি। ছুটির দিনে সংসারের সব কাজ সেরে খেয়ে উঠতে উঠতে দুটো বেজে যায়। খেয়ে উঠে ভালো করে মেঝে মোছে মা। তার আগে স্নান করার পর ভেজা শাড়ি, ভেজা গামছা টানটান করে মেলে দেয় রোদের দিকের জানলাগুলোতে। খড়খড়ি দেয়া জানলা আগেই বন্ধ করা হয়ে গেছে ওতে ঘর ঠাণ্ডা হয়। তারপর মেঝেতে দুটো বালিশ পেতে ছেলেটাকে শুতে বলে। ছেলেটা শুতে চায় না। মা বলে, ‘ঘুমতে হবে না শুয়ে থাক।’ ছেলেটা জানে, কিছুতেই ঘুমবো না ভেবে শুয়ে থাকলেও কখন যেন ঘুম এসে যায়। মা ভেজা চুলটাকে বালিশের ওপর দিয়ে মেঝে অবধি ছড়িয়ে দেয়। কেশুত তেলের গন্ধ পাওয়া যায় চুল থেকে। গা থেকে মার্গো সাবানের গন্ধ। গন্ধটা নাকে এলেও যেন তেতো লাগে জিভটা। কী তেতো সাবানের ফেনাটা। মায়ের হাতের কাছে একটা ভেজা গামছা ভাজ করা থাকে। মাঝে মাঝে ঘুমন্ত ছেলেটার গলা বুক থেকে ঘাম মুছে দেয়। ঘুমের মধ্যে টের পায় ছেলেটা। মাথার ওপরে আদ্যিকালের ডিসি ফ্যান ঘোরে বনবন করে। খটখট করা রেগুলেটারটা পাঁচে করা থাকে।
পাশের বাড়ির ওই বুড়ো যেমন কিছু বোঝে না।সামনের সিমেন্টের চাতালে খেলার সময়জানলা দিয়ে দেখা যায় বাইরের ঘরে শুয়ে থাকা বুড়োকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বুড়োর বড়োবউমা স্টিলের গেলাসে জল খাইয়ে দেওয়ার সময় মাথার পিছনে দেয় বাঁহাতটা। গেলাস ধরে জল খাবার শক্তি নেই। তবু কাঁপতে কাঁপতে হাতটা ওঠে। গেলাস ধরতে যায়। বুড়োর বউ ঘরে ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরে। সিঁথিতে মোটা করে সিঁদুর দেয়। আর উবু হয়ে বসে দেখে। কাঁদে মাঝে মাঝে। বড়োবউয়ের এই ঘ্যানঘ্যানানি ভালো লাগে না। আর কোনও ছেলে-বউ তো দেখে না। তাদের ছেলেমেয়ে আছে। তাই নিয়ে তারা আলাদা হয়ে গেছে আসেপাশের পাড়াতেই। বড়োবউয়ের ছেলেমেয়ে হয়নি। কার দোষ কেউ জানে না। তবু এই বুড়ি শাশুড়ি বাঁজা বলতে ছাড়েনি। অন্য দুই বউয়ের ছেলেমেয়ে হওয়ার পর আরও বেশি করে। বড়োবউ মনে মনে জানে কার দোষ। কিন্তু আর কাউকে বলে না। শাশুড়ির সেই ঠোনা শুনে এখনও বুড়োর সেবাযত্ন করতে সেই বড়োবউকেই লাগে বুড়ির। আর কেউ দেখে না।বড়োবউ আবার কোথায় গেলে গোঁসা হয় বুড়ির। গজগজ করতে থাকে। ফিরে এলে বাপ-বাপান্ত করে হাওয়ার দিকে তাকিয়ে, তার নাম না করে। আবার বুড়োকে খাওয়ায় বড়োবউ। গামছা দিয়ে মুখ মোছায়। স্টিলের গেলাসে জল খাওয়ায়। বুড়োকে চাগিয়ে তুলতে, শুইয়ে দিতে আবার বুড়ি হাত লাগায় বড়োবউয়ের সঙ্গে।
একদিন ছেলেটা দেখে বুড়োর লুঙ্গি তোলা বুড়োর লঙ্কাটা এত্ত বড়ো। ওমা এতো বড়ো হয় নাকি! সেটা হাত দিয়ে ধরে বুড়ি সেটাকে একটা চ্যাপ্টা সাদা ঢাকা দেওয়া বাটির মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বুড়ি বলছে, ‘করো। করো।’ বুড়ি বলেই চলেছে, কী গো, করো এই তো দিয়েছি।’ বুড়ো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বুড়ির। বড়ো বউ দরজার কোনে অন্য দিকে মুখ করে বলছে, ‘মা, এখন বোধহয় উনি করবেন না, ছেড়ে দিন।’ বুড়ো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে বুড়ির দিকে। খানিক বাদে দেখে বুড়ো হিসি করছে ওই বাটিতে। কী লজ্জা ! কী লজ্জা ! এ মা। এত বড়ো লোক, তাকে কিনা ...। সেও তো নিজে বাথরুমে গিয়ে হিসি করে আসতে পারে। এসব কথা তো কাউকে বলা যায় না। কাউকে না। ছিছি। ছেলেটা জানল বুড়ো একা একা হিসি করতেও পারে না। আরেক দিন ওই রকম। বুড়ি বোধহয় হিসি করাতে নিয়েছিল বুড়োকে। বড়োবউ সেই অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। বুড়ি হাত দিয়ে ধরে আছে। বুড়ো হিসি করে না। উলটে বিড়বিড় করে। বুড়ি বলে ‘কী? কী বলছ?’ বুড়ো বলে ‘করো, করো’। বুড়ি আরেক হাতে আঁচল মুখে দেয় চোখে জল। ফিরে দেখে বড়োবউ আছে কিনা। বড়োবউ দরজার পাশ থেকে সরে যায়। ছেলেটা পালায় জানলার কোনা থেকে। বোঝে কিছু একটা হয়েছে। এখানে ওর থাকার নয়।
বুড়ি বেশি গজগজ করলে বড়োবউ বলে ছেলেটার মাকে। ছেলেটা শোনে তেমন বোঝে না কথাগুলো পুরো। মা বড়োবউকে দিদি ডাকে। ছেলেটা জেঠিমা। জেঠিমা ছেলেটার জন্য চানাচুর এনে রাখে, ইট লজেন্স এনে রাখে। চানাচুর দেয় টেবিল ক্যালেন্ডারের আগের দিনের পাতা ছিঁড়ে চোঙ বানিয়ে। চোঙটা মুঠোয় নিয়ে ছেলেটা আবার হায় পাতে। হাতে আরেকটু চানাচুর দেয় জেঠিমা। ইট লজেন্স কী শক্ত, কামড়ালে চটচটে লজেন্সটা দাঁতে আটকে যায়। গুঁড়োদুধ দেয় ছেলেটার হাতে। তার আগে লাইফবয় দিয়ে হাত ধোয়ায়। ছেলেটা চেটে চেটে গুঁড়োদুধ খায়। রোদ্দুর থেকে নামানো আচার খায়। জেঠিমা ছাদে বড়ি দেয়, সাদা কাপড়ের ওপর। ছেলেটা পাশে বসে বসে দেখে রবিবার আঁকার ইস্কুল থেকে ফিরে। একদিন জেঠিমা ছেলেটার সামনে হাঁটুগেরে বসে। ছেলেটা হাত পেতে আছে গুঁড়োদুধের জন্য। টিন কাটা আমুলের কৌটোর মধ্যে চামচ ঢুকিয়ে জেঠিমা বলে, ‘আগে বল মা, তবে দেব।’ ছেলেটা কী বলবে বুঝে পায় না। জেঠিমা আবার বলে, ‘বল মা, বল।’ ছেলেটা বলে, ‘মা।’ গুঁড়োদুধ দিয়ে দিতে জেঠিমা কাঁদে। কেন কাঁদে বোঝে না ছেলেটা।
সিমেন্টের চাতালে বুড়োর ঘরের পাশের জানলাটা বড়োবউয়ের ঘরের। ওপরে একটু ফাঁকা রেখে দুটো স্প্রিং দিয়ে পর্দা টানা থাকে। বড়োবউ খুব পিটপিটে। পাড়ার লোকে বলে ছুঁচিবাই। মা বলে আগে এরকম ছিল না। বড়োবউ বারবার স্নান করে। কাজের মাসির পিছনে টিকটিক করে। নিজে আবার বিকেল বেলা ঘর মোছে। গামছা পরে স্নান করে বেরোয়। ছেলেটা দেখেছে। তারপর ঘরে এসে শাড়ি পরে, চুল আঁচড়ায়, সিঁদুর পরে, শাঁখায় সিঁদুরের আঙুল লাগায়। ছেলেটা বড়োবউয়ের টানটান করে চাদর পাতা বিছানায় বসে বড়োবউকে সাজতে দেখে। একবার কার বাড়িতে কী কাজ হবে সিমেন্টের চাতালে। পাড়ার ছেলেরা খেলে ওই ঢাল করা বালিতে। কেউ একটা বলে বালি ছোঁড় ওই ওই পর্দার ফাঁক দিয়ে। সেও কেন জানি ছুঁড়ে দেয়। বালি গিয়ে ঢোকে বড়োবউয়ের ঘরে। বড়োবউ দেখে ফেলে তাকে। কিন্তু কিচ্ছু বলে না। সারাদিন ধরে ওই বালি পরিষ্কার করে রাত্তিরবেলা আবার চান করে পাড়ার পিটপিটে ছুঁচিবাই বড়োবউ।
দুদিন একটু বৃষ্টি হলেই বাড়ির সামনের রাস্তায় জল জমত। জানলা দিয়ে সামনের রাস্তাটা দেখা গেলেও রাস্তা গিয়ে যে বড়ো রাস্তায় পড়েছে সেই ট্রামলাইনের রাস্তাটা দেখতে গেলে বারান্দায় আসতে হত। সারারাত বৃষ্টি হয়েছে।নিচে জল থইথই করছে। সুতলি পাকানো খবরের কাগজ তখনও পড়েনি বারান্দায়। কাগজকাকু সাইকেল চালাতে চালাতেই কাগজটাকে ছুঁড়ে দেয়। অনেক দিন দেখেছে ছেলেটা। এমনকি ছোঁড়ার পরে আর ঘুরেও দেখে না ঠিক পড়ল কিনা গিয়ে। কী টিপ! ওর এরকম টিপ নেই। পরপর কটা বারান্দায় এরকম ছুঁড়তে ছুঁড়তে যায়। তারপর একটা বাড়ির সামনে নামে কাগজ দিতে। তখন আর দেখা যায় না। এই জলে কাগজকাকু আসেনি। আজ স্কুল যাওয়া যাবে না। ছেলেটার সকালে স্কুল। বড়ো রাস্তার ওপারে ট্রামলাইনের সামনে থেকে বাসে করে স্কুলে যেতে হয় তাকে। শিয়ালদার উড়ালপুল পেরিয়ে ডানদিকে যায় বাস। ওদের বাড়ির নিচে কচুরির দোকান। ভিতরে খুব অল্প জায়গা হলেও বসে খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। বেশিরভাগ লোক কিনে নিয়ে চলে যায়। চপ, খাস্তা কচুরি, ফুলুরি, শিঙাড়া। মিষ্টি ক্ষীরের চপ, ক্ষীরের শিঙাড়া, মুগের নাড়ু, জিলিপি কত কিছু পাওয়া যায়। সেই দোকানেও জল ঢুকে গেছে বলে আজ উনুন জ্বালানো হয়নি। আসেপাশের বাড়ির লোকজনকে ডেকে কালকের মিষ্টিগুলো দিয়ে দিচ্ছে ওরা। আজ দোকান বন্ধ থাকবে। ওদের বাড়ির সামনের রাস্তার ওপারে মিষ্টির দোকান বেশি উঁচু। ওদের দোকানে জল ঢোকে না। একবার ঢুকেছিল। সেবার সামনের রাস্তায় নৌকা চলতে দেখেছে ছেলেটা। ট্রামরাস্তার থেকে লোকজনকে ওদের রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকে পার্কের গলিতে কিমবা আরও ভিতরে যাদের বাড়ি সেখানে পৌঁছে দিয়েছিল। বড়োরা বলত, অমুক রাস্তায় নাকি ট্যাক্সি ডুবে আছে। স্কুল থেকে হেঁটে ফিরতে গেলে ওই রাস্তা দিয়েই ফিরতে হয়। একবার বড়কা ওইরকম জলের মধ্যে নিয়ে এসেছিল ছেলেটাকে স্কুল থেকে। অনেক পথ ঘুরে ঘুরে। তারপর বেঁটেখাটো বড়কা ট্রামরাস্তা থেকে ওকে কাঁধে করে এনে সিঁড়িতে নামিয়েছিল। কালীতলার কাছে নাকি বাসের ভেতর জল উঠে গেছে সেদিন ওদের সামনের রাস্তায় অল্প জল হলে তার মধ্যে দিয়ে গাড়ি যেত আর বড়ো বড়ো ঢেউ উঠত। রাস্তা ছাপিয়ে, ফুটপাথ ছাপিয়ে, ওদের বাড়ির নিচে সিঁড়ির দুটো তিনটে ধাপ ডুবে যেত জলে। পুরনো খাতার পাতা ছিঁড়ে নৌকা বানিয়ে ছাড়ত ছেলেটা। নৌকার গায়ে আর্টেক্সের কালিপেনে নাম লিখে দিত নিজের। ডটপেনে ছোটোরা লেখে না। হাতের লেখা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু নৌকা খানিক ভাসতেই সুলেখার নীল কালি ধুয়ে যায় রাস্তার জলে। নৌকার গায়ে ছড়িয়ে যায় কেমনকেমন। একদিন দুদিন পরে যখন জল নামে তখন আর সেই নৌকাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ম্যানহোলের ঢাকনা যখন তুলে দিয়েছিল তখন নিশ্চয়ই ওইখান দিয়ে গঙ্গায় চলে গেছে। ইস যদি সেই টুয়েন্টি থাউজেন্ট লীগসের মতো নটিলাস বানাতে পারত তাহলে ওটা নিশ্চয়ই বঙ্গোপসাগরে যেত জলের তলা দিয়ে। 
পার্টির কাকুরা কাগজ দিতে আসত রাত্রিবেলা। ওদের সঙ্গে আসত বড়কা। বড়কা ওদের উলটো দিকে থাকে। বেঁটেখাটো চেহারা। স্ত্রাইপ পাজামা আর শার্ট পরা, শীতে গায়ে তুষের চাদর। বড়কা মাঝে মাঝে মিটিং করতো পাড়ায়। রাস্তার কোনে মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে। কলেজ পাশ করার পরে চাকরি পায়নি তখনও। বাকি ভায়েরা মানে মেজকা, সেজকা আর ছোটকা। পিঠোপিঠি ভাই সব। তারা পাশ করে নানা চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে পার্টি করে বেড়াচ্ছে। বাড়িতে নানা গঞ্জনা শুনতে হত বড়কাকে। সে আরও বাড়ল মেজকা চাকরি পেয়ে যাওয়ায়। বড়কার তখন বাড়িতে টেকা দায়। সকালে উঠে জামা প্যান্ট পরে বেরিয়ে পরে। টিউশুনি পড়ায়। সন্ধের পর পার্টির কাজ করে। দুপুরে খাওয়া রাতে খাওয়া-ঘুমনো ছাড়া বাড়িতেই থাকে না। একেকদিন বিকেলে পাড়ার রকে বসে থাকে। বিড়ি সিগারেট কিছু খায় না। চাও দুবার খায়। সকালে আর বিকেলে। আগে সেটা বাড়িতেই জুটত একদিন কী সব কথার পর থেকে সেই চাও খায় নিচে কেটির দোকানের বেঞ্চিতে বসে। হাতটাত নেড়ে কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের কী যেন বোঝায়। সেটা পার্টির কাজ নাকি ওই সময় টিউশুনি নেই অথচ ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করে না ওর কে জানে। এক্সচেঞ্জ না কী সেখান থেকে ওর কোনও চিঠি আসে না। ও বেকার বলে বাড়িতে খারাপ কথা শোনে। আবার বেকার ছেলে পার্টি করে সময় নষ্ট করে বলে পার্টিকেও খারাপ কথা বলে বাড়ির লোক। এটা ওর বড়ো গায়ে লাগে। ছেলেটার বাবাকে মাঝে মাঝে বলে বড়কা। আবার বলে, ‘নানা ভেঙে পড়িনি। হয়ে যাবে একটা কিছু। বুঝলেন বড়দা।’ মা বলে, ‘বোস, অশোক চা আনছি।’ বড়কা বলে, ‘হ্যাঁ বউদি, আছি।’
পিঠে একটা বড়ো তিলের মতো ছিল বড়কার। সেটা এক সময় বাড়তে শুরু করল। ছোট্টো মটর ডালের মতো তিল বাড়তে বাড়তে ক্যাম্বিস বলের সাইজে হয়ে গেল। ‘কী রে অশোক ওটা ডাক্তার দেখাচ্ছিস না?’ - ‘হ্যাঁ ওই দেখাচ্ছি।’ অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারের ভিজিট বেশি। ওষুধেরও দাম বেশি। তাই হাসান না কি যেন এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারকে দেখানো হতে লাগল। সেই ক্যাম্বিস বল কমে তো নাই উলটে বাড়তে থাকে। ডাক্তার নাকি ওটাকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে ফাটিয়ে দেবে। টিউশুনি বন্ধ। পার্টির কাজ পড়ায় বন্ধ। বড়কার গায়ে গরমকালেও একটা তুষের চাদর। পার্টির লোকেরা একদিন ওদের বাড়ি এলো। বাড়ির লোক প্রায় দুরদুর করে তাড়ালো ওদের। সারাদিন কোনার একটা ছোটো ঘরে বসে থাকে বড়কা। লুকিয়ে রাখে নিজেকে। রোববার রোববার করে দুপুরের পর খবরের কাগজ চাইতে আসে। ওই ঘরে বসে চাকরির অ্যাপলিকেশন লেখে দিস্তা কাগজে। কাগজ চাইতে এলে ঘরে ঢোকে না বড়কা। বললেও ঢোকে না। কুঁজো হয়ে গেছে কেমন পিঠের ভারে। একদিন এমনই রোববার বড়কা দুপুরবেলা কাগজ চাইতে এসে জানলার গরাদ ধরে অনেকক্ষণ কথা বলে বাবার সঙ্গে। তারপর হঠাত কী মনে হওয়ার তাড়াতাড়ি কাগজ নিয়ে চলে যায়। বাবা বাইরে বেরিয়ে দেখে জানলার নিচে রক্ত পড়ে আছে। রক্তের লাইন চলে গেছে দরজার দিকে। সেদিন রাতেই বড়কার বাড়ির লোকের সঙ্গে তুমুল অশান্তি করে পার্টির ছেলেরা ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে। ওর অপারেশনের পরে জানা যায় মটর ডালের সাইজের তিলটা সাড়ে সাত কেজি হয়ে  গিয়েছিল বাড়তে বাড়তে। অপারেশনের পরে বেশিদিন বাঁচে না বড়কা। এক টিপটিপে বৃষ্টির রাতে চিত্তরঞ্জন থেকে বডি আসে ওদের বাড়ির নিচে বড়কার বাড়ি থেকে কেউ বেরোয় না। তারপর পার্টির পতাকায় মুড়ে সাতাশ বছর তিনমাস বয়েসে বড়কার দেহ চলে যায় নিমতলায় মিছিলে কঠিন মুখে হাঁটে বাবা। স্লোগান শোনে ছেলেটা, কমরেড অশোক চক্রবর্তী অমর রহে। অমর রহে, অমর রহে। 
এর মাসখানেকের মধ্যে একটা চিঠি আসে বাবার কাছে। জানলার কাছে এসে সই করিয়ে দিয়ে গেছিল বোধহয়। চিঠি অশোক চক্রবর্তীর নামে। কেয়ার অফের জায়গায় বাবার নাম। বাবাকে একদিনই মাত্র কাঁদতে দেখেছিল ছেলেটা ওই চিঠি হাতে। ওই জানলাটার গরাদ ধরে। এমপ্লয়েমেন্ট এক্সচেঞ্জ না কী বলে তার চিঠি। বড়কা একটা চাকরি পেয়েছিল।
                                                                                                       

                                                                                                                                      (ক্রমশ )

No comments:

Post a Comment