Wednesday 20 December 2017

মা সু দ খা ন


এক অন্তর্লীন মিল ও যোগাযোগ শিশুতে-কবিতে-প্রাকৃতিকতায়




তবে কি শিশুর ভেতরে বাস করে এক স্ফূর্ত, ফুল্ল কবি, আর কবির ভিতরে এক প্রাজ্ঞ, পরিণত শিশু?  

রংপুর থেকে বদলি হয়ে বগুড়ায় এসেছি। বনানীতে করতোয়ার ধারে অয়্যারলেস কম্পাউন্ড। আমাদের জন্য বরাদ্দ একতলা নতুন বাসা। রকমারি ফলের গাছ, বাহারি ফুলের কেয়ারি, প্রবেশপথের দুই ধারে সার করে লাগানো রজনীগন্ধা। পাশেই কৃশকায়া করতোয়া। পুবালি বাতাসে জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর। নদীর ওপারে সবুজ মাঠ।

বাসার সামনে বড়-বড় গাছগাছালি-ভরা এক আয়তাকার বাগান। কথিত আছে, আগের দিনে জমিদারদের বাগানবাড়ি ছিল এখানটায়। জঙ্গলটাকে পার্কে রূপান্তরের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। দেয়াল উঠবে। চৌকোনা সব গর্ত খুঁড়ে তাতে কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পিলারের ভিত। প্রতিটি ভিত থেকে উঠে এসেছে চার-চারটি করে লোহার রড। তবে কী এক কারণে বহুদিন ধরে স্থগিত হয়ে আছে নির্মাণকাজ। প্রকৃতির প্রহারে ধীরে ধীরে মরিচা ধরে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে লোহাগুলি। মানুষ আর গরুবাছুরের অত্যাচারে দিনে-দিনে ন্যুব্জ হয়ে এদিক-ওদিক হেলে পড়েছে একসময়কার ঋজু ও তরতাজা রডগুলি।

প্রথম যেদিন এলাম, আমাদের ছোট ছেলেটি-বয়স তখন কতই-বা হবে, বড়জোর সাড়ে চার-ঘুরে-ঘুরে ছুটে-ছুটে দেখছে সব, আশপাশ, পরিবেশ। নতুন ডিজাইনের একতলা বাসা, করতোয়া নদী, ফলফুলের সাজানো বাগান, প্রশান্তিপ্রদ হাওয়া, পাখপাখালির ওড়াওড়ি, কিচিরমিচির... সবকিছু ছাপিয়ে প্রথম দেখাতেই যা তার মনে দাগ ফেলেছে তা হলো একের পর এক চৌকোনা গর্ত থেকে উঠে-আসা মর্চে-ধরা নুয়ে-পড়া সেই লোহার সিরিজ। নতুন জায়গায় এসেই তার প্রথম অনুভূতি, প্রথম প্রতিক্রিয়া: “কারা যেন লাইন ধরে লোহার গাছ লাগিয়েছিল, পানি দেয়নি তাই মরে গেছে সব”।

বাহ্! শিশুর মনে এক কাব্যিক কল্পনা। এক অতিকায় উৎপ্রেক্ষিত উপমা। প্রাত্যহিক বাস্তবতায় কনডিশনড-হয়ে-যাওয়া বড়দের মনে চট করে এরকম ভাবোদয় হয় না সচরাচর, হলেও তারা ব্যক্ত করে না এভাবে। তবে কবিদের হয় এবং অবলীলায় তা ব্যক্তও করে কবিতায়। আর শিশুদের মতো কবিরাও তো বহুবিচিত্র বিষয়ের সমাহার থেকে, বহু বর্ণাঢ্য ও নান্দনিক বিষয় ফেলে রেখে হঠাৎ-হঠাৎ চয়ন করে সৌন্দর্যরিক্ত মামুলি কোনো বিষয়। তারপর রূপারোপ করে তাতে।

আরেকবার। ঢাকা থেকে সিলেট যাচ্ছি মাইক্রোবাসে করে। মাঝে-মাঝে পথের বাঁকে “সিলেট” লেখা তিরচিহ্নিত দিক-নির্দেশফলক। সেগুলি খেয়াল করেছে আমাদের শিশুকন্যা। একসময় বিস্মিত শিশু তার মাকে জিজ্ঞেস করছে, “মা, ওরা জানল কীভাবে যে আজ আমরা সিলেট যাব? 

শিশুদের মনোজগৎ এক বিচিত্র জগৎ, যেখানকার বিন্যাস ও মানচিত্র আলাদা, আলাদা তার যুক্তি ও শৃঙ্খলা। শিশুর ধারণা, সে সিলেট যাবে আর সেই খবর কীভাবে যেন চাউর হয়ে গেছে চরাচরে। তাই তার যাবার পথ নির্বিঘ্ন করতে কারা যেন সারারাত ধরে পথের বাঁকে বাঁকে লাগিয়ে দিয়েছে ওইসব দিক-নির্দেশক সাইনবোর্ড।  

এক সারল্যমাখা আচমকা অভিব্যক্তি। আর এরকম অভিব্যক্তি আমরা মাঝে-মাঝে ঝলকে উঠতে দেখি কবিদের কবিতায়, যেখানে সারল্য আসে প্রাজ্ঞের সারল্য হয়ে, বহু-বহু জটিলতার সরল সারাৎসার হয়ে। এ প্রসঙ্গে রণজিৎ দাশের একটি কবিতার কথা মনে পড়ল যেখানে কবি জানাচ্ছেন-- সারাদিন অসংখ্য বাস, ট্রাম, গাড়ি, মানুষ, রোদ, ধুলা, চিৎকার, কোলাহল... ঘর্ষণে-ঘর্ষণে আর অত্যাচারে-অবিচারে চিরে-চিরে যায়, তছনছ হয়ে যায়, মহানগরীর ব্যস্ততম সব রাস্তা। আর প্রতিদিন রাতের বেলা সেগুলি ঠিকঠাক গোছগাছ করে রাখে মিনিবাস চালকের মা, যেটুকু সময় ছেলে তার বউয়ের সঙ্গে গল্প করে, দেশি মদ খায়, সেইটুকু অবসরে... যেন ভোরবেলা মিনিবাস নিয়ে বেরিয়ে ছেলে তার দেখতে পায়, বাহ্, কী সুন্দর সব রাস্তা! কে যেন সারারাত ধরে ঠিকঠাক করে রেখেছে তার জন্য।  

শিশুদের কথায়, কল্পনায়, আমরা আরো লক্ষ করি স্থান ও কালের অতর্কিত স্থানচ্যুতি, ইন্দ্রিয়নিচয়ের আচমকা ভূমিকাবদল। কবিদের ক্ষেত্রেও কি আমরা দেখতে পাই না সেরকমটা, মাঝে-মাঝে, বিরল মুহূর্তে? বিলক্ষণ পাই।    

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-- নিজের প্রাণের মধ্যে, অপরের প্রাণের মধ্যে, প্রকৃতির প্রাণের মধ্যে প্রবেশের ক্ষমতাই কবিত্ব। মনে হয়, শিশুরা আর কবিরা (অর্থাৎ নন্দনশিল্পীরা) নিজের, অপরের, এবং প্রকৃতির প্রাণের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে সবচেয়ে সার্থকরূপে, সবচেয়ে প্রাকৃতিকভাবে। কবির অনুভূতির সৎ ও প্রাকৃতিক প্রকাশ তাঁর কবিতা। শিশুর অভিপ্রকাশও সৎ, অকপট ও প্রাকৃতিক। তবে কি কবির কবিত্ব আর শিশুর শিশুত্ব একই রকম? নিশ্চয়ই না। কবির কবিত্ব হলো প্রাজ্ঞের প্রাকৃতিকতা, পক্ষান্তরে শিশুর শিশুত্ব হচ্ছে সারল্যের প্রাকৃতিকতা।

এক গূঢ়, অন্তর্লীন মিল ও যোগাযোগ শিশুতে-কবিতে-প্রাকৃতিকতায়।      
    




















No comments:

Post a Comment