Wednesday 20 December 2017

গুলশনারা


গল্প

পাগলীরা

গুলশনারা

বিশু পাগল... বিশু পাগল... অ্যাই ছোড়া, লোকটাকে দেখতে পেলে পাঠিয়ে দিস তো। সেই কোন ভোরে দুটো মুড়ি খেয়ে বেরল।
দেব গো পিসি। তোমার সে লোক অন্য মেয়েছেলের কাছ থেকে ফিরুক আগে।

ছেলেগুলো হেসে সাইকেলে ধুলো উড়িয়ে চলে যায়। এই হল নিত্যদিনের ডাক সরবরাহ। কেয়াতলা রোডের শেষ বাড়িটা একটু আলগোছেই লুকিয়ে থাকে। পুরনো সবুজ রং ওঠা খড়খড়ি খুলে পাগলিটা রোজ ভর-দুপুরে বিশুকে ডাকে। ছেলেগুলো কেমন ওত পেতে থাকে। এই বুঝি পাগলি ডেকে উঠল। এক বূক হাহাকার নিয়ে, শুকনো মুড়ি খেয়ে কবে যে বিশু পগার পার। পাগলিটা বুঝেও বোঝে না। ছেলেগুলো সাইকেলের ঘন্টি মেরে নিচে হল্লা করে। দাগ লাগা শ্যাওলা শার্ট, লালচে, নিলচে ইজের গায়ে অহংকার বলতে এই এক পিস করে সাইকেল। এবার সরক্যার থেকে দিয়েছে কিনা। গরিব মানুষ না খেতে পাক, অন্তত সাইকেল চেপে ঘুরুক খানিক কলকাতা। সে বিশু কবে কোন বিভূঁইয়ে ঘর পেতেছে। বাড়ির তিন তলার পাগলিটার জেনে কাজ নেই। সে রক্তকরবী খুলে দেখেছিল বোধহয় কোনওদিন। ছেলেগুলো রোজক্যার চেনা উত্তরটা দিয়েই শিস দিতে দিতে চলে যায়। পাগলিটার আর এক দিনযাপন আমরা জানি না।

বাড়ির ভিতরে উকি মারলে হরেক রং-এর কারখানা। এককালে বুড়ো বাবু দাঁড়িয়ে থেকে গ্র্যাচুইটি আর প্রভিডেন্ট ফান্ড এর টাকা মিলিয়ে জম্পেশ বাড়িখানা গড়েছিলেন। নহবত না বসুক, সপ্তাহ বা মাসান্তে একবার পরিবার নিয়ে বৈঠক হত। পাগলিরা তখন তিনটি ছোট বোন। হিংসুটি-কুটকুটি সব কটা মিলে ডিডি মেট্রো চালিয়ে মিলে সুর মেরা তুমহারা দেখে কমল হাসানকে ফ্যান্টাসাইজ করত। অবশ্য কমল হাসান সে কথা এখনও জানে না। সদমা দেখে ছোট পাগলির খুব ইচ্ছে হয়েছিল, ঠাকুর, ঠাকুর, আমায় শ্রীদেবীর মতো পাগলি বানিয়ে দাও। আমি কমল হাসানকে ঠিক চিনতে পারব। লোকনাথা বাবা, জিশু খ্রিষ্ট, আল্লা গো তিন দেবতা স্বর্গে তাস খেলতে খেলতে ঠিক শুনেছে। বাবা ঠাকুরের লম্বা কান।

ছোট পিসি? খই-দই মেখে রেখে গেলুম। চানের জল গরম করা আছে। আর বাপু এবার ঘরে এসে নেয়ে-খেয়ে নিয়ে আমায় উদ্ধার কর তো। কে যে তোমার বিশু পাগল, আর কোথায় গেছে সে মিনসে। অমন মোমের পুতুলের মেয়ে, কি ভাগ্যি মা গো। ঝ্যাঁটা মারি কপালে। বাড়ির ঝিয়ের কথালাপও  কম্পিউটারে তোলা, পরপর সাজানো। পাগলিটা সব শোনে। রোজই ভাবে আরও কিছু বলার ছিল। খেই হারিয়ে যায়।
সে আসুক না। দেখিস। নালিশ করে দেব তোর নামে নমিতা। ঝি মানুষ অত কি তোর কটকট কথা।
নমিতা আর কথা বাড়ায় না। বাথরুমে শালিমার তেলের কৌট মেজে রাখে, ্যাকে সাজানো তুহিনা আর বডি অয়েলের গায়ে ছাতা পড়ে গেছে। মুছে, ঝেড়ে বাক্সবন্ধ করে রাখে। তিরিশ বছর হয়ে গেল বাড়িতে। মোমের বয়স তখন তিন বছর। নমিতা কোলে-পিঠে গড়েছে। ওপরের দুই দিদির মাথার ব্যামো ছোট থেকে বোঝা যেত। স্কুলে নিয়ে যেতে গেলে মুখে কালি মেখে বসে থাকত মাম আর মিমি। কিসব মাথার ডাক্তার নিয়ে এল বড় বাবু। সে কি লজ্জার অসুখ মা। পিঠোপিঠি দুই বোন। বয়স কত তখন, ১০-১২। বাথরুকে ঢুকে সে এক কেলেংকারি। নমিতাই তো দেখেছিল। বাথরুমে চানের নাম করে মামদিদি মিমিদিদির প্যান্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। ওইটুকু দুই মেয়ে শিউরে শিউরে উঠছে। নমিতা তখনও চুপ করেছি।। তারপর সেবার সেই চিলেকোঠায়। তখন ওরা বড় স্কুলে। ছিঃ ছিঃ, ন্যাংটো দুই বোন সে কি কান্ড। নমিতা বড় মা-কে বলে দিয়েছিল। বাবা-কাকা-জেঠা মিলে মেরে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয় আর কি। তারপরই তো এল মাথার ডাক্তার। এখন নাকি মেয়েরা মেয়েরা করে, আরও কিসব বলল। এত বড় বাড়ির নাম খারাপ করতে সেই যে পড়ার পাঠ চুকল দুই মাগির। এখন থাক দোতলায় শেকল বেঁধে। নমিতা নিজে একদিন গিয়ে দেখে এসেছিল খাবার দেবার সময়। বুড়ি হয়েছে, তবু তার কি তেজ। গা উদোম না রাখলে মাথায় নাকি পোকা নড়ে। পোকা উড়ে মোমদিদির মাথাতেও ঢুকল কেন ঠাকুর।
মোমের দেশে পুতুল পুতুল ব্যাপার সব। মা খুব সাজিয়ে দিত তকন। তুলো-তুলো জামা, ফুল-ফুল ক্লিপ আর ফিতে বাঁধা জুতো। মোম তো বংশের শেষ বাতি। জেঠু বলেছিল, খাঁদা নাক তো কি। দাড়িপাল্লা মেপে টাকা তুলে দেব। দত্ত বাড়ির মেয়েকে পাত্রপক্ষ স্বয়ম্বরে নিয়ে যাবে।
তা মোমের স্বয়ম্বর হয়েছে। একেবারে বেছেবুছে তুলে নিয়ে গেছিল। কলেজে প্রশান্ত স্যার মায়াভরা চোখে রক্তকরবী পড়াতেন আর বারবার বলতেন ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা মোম ওসব ধার মাড়ায়নি সেকালে। কিসব ফ্যান্তাফ্যাচাং জিন্দাবাদের নাড়া লাগিয়ে কলেজ গরম করত  ইতিহাসের ছেলেগুলো। মোম ফিরেও তাকায়নি বেশ তো, বিশু পাগল ফুল তুলে এনে দিক নন্দিনীকে। মোমের একট্যাঁ গালভরা রাজনন্দিনী নামটা প্রশান্ত স্যার নোনতা বিস্কুটের মত ডাকত। ফুলতোলা সালওয়ার কামিজের মোম কান পেতে বসে থাকত, কখন আসে রাজার ডাক। দিদির ঘরের আলমারিতে মায়া অ্যাঞ্জেলিউ-এর বইয়ের পাতায় ছোড়দির নাম লেখা ছিল। মোম তখনও জানত, বড়দি-ছোড়দির বিয়ে হবে। সে বিয়ে ঠেকাতেই নাকি শেকল বেধে বেঁধে রাখ হয়। মোম তখনও জানত না, নোনতা বিস্কুটের স্বাদ মিলিয়ে দিয়ে প্রশান্ত স্যার ব্যাঙ্গালোর চলে যাবে। কমল হাসানের বাড়ির ঠিকানা চেনে না মোম। ইতিহাসের ছেলেগুলো আজও জিন্দাবাদ করে চিল্লায়। মোমের কাছে পাতালপুরীর চাবি রাখা ছিল।
এত দিন হল বূকের দাগটা এখনও উঠল না গো দিদি। পুলিশ হলে কি এরা আর মানুষ থাকে না? নাও নাও আর উদোম গায়ে বসে থেকোনি। মাঘের বেলা। নমিতা গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায় সেও তো নিত্য দিনের কথা। নন্দিনীর হাতে বেলফুল, মালা, শিউলি, বকুল। বাড়ির কাকিমা বুড়ো মানুষ, আজও ঠাকুর ডেকে ফুল দিয়ে যায়, এবাড়ির কুলুংগিতে তোলা শিবের লিংগে। মায়া অ্যাঞ্জেলিউর সঙ্গে জোট বেঁধে অতুলপ্রসাদের বইটা নমিতা বেচে দিয়ে এসেছে গেল মাসে। নন্দিনী কি যেন ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। ইশ এবার ডিডি মেট্রোতে ছুটি-ছুটি দিল না কেন?
কি বিরাট স্বয়ম্বর মাগো। এক ভ্যান পুলিশ আর হাতকড়া। নন্দিনী লালবাজারে ঘুলঘুলি খুজত। মা এসেছিল একবার। বাবা আসেনি। নোংরা মেয়ে। বংশে কালি। প্রশান্ত স্যারের বিজয়গড়ের ছোট্ট ঘরটা বেশ চমতকার। নন্দিনী পারত না কিছু। বেল ফুল শরীরে ছড়িয়ে শুয়ে থাকত তক্তায়। প্রশান্ত স্যার মায়াচোখে কমল হাসানের মতো সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিত।
জিন্দাবাদ আমার ভাল লাগে না
আমি যদি কখনও না থাকি, আমার বইগুলো পুড়িয়ে ফেল। আর হ্যাঁ অমিয়কে কিছু টাকা পাঠিও লুকিয়ে।
তোমায় যে আমি কোথাও যেতে দেব না বিশু পাগল
পাতালপুরী তখনও নন্দিনী যায়নি। প্রশান্ত স্যারের মা এসে কেদে পড়েছিল পায়ে। এক ছেলে নিয়ে গাঁয়ের বুড়ির তখন চোখে চকচক স্বপ্ন। ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টে নাকি মদ পাওয়া যায়, নন্দিনী জানত। পাতালপুরি তখনও চেনেনা নন্দিনী। পুলিশ আসে দিন দশ পরে। বিজয়গড়ের বাড়িতে আগুন লেগে সব পুড়েছে। নন্দিনীর মোম রঙা ওড়নাটা উড়ে অ্যান্টেনায় বেঁধেছিল। এক কলেজ মেয়ের মাঝে নন্দিনীকে স্বয়ম্বরের জিপে তুলেছিল যখন ওরা, ইতিহাসের ছেলেগুলো আর জিন্দাবাদ বলেছি। পাতালপুরীর রাজা সে ভারি চমৎকার। নন্দিনী জানতই না, তার বুক, পেট, থাই, যোনির এত কদর বাপু। কি জ্বালা। আমায় বকুল ফুলে সারিয়ে তুলো বিশু পাগল নাহ পুলিশগুলো ভাল। রঞ্জন বেঁচে গেল। বিশু কোথায় যেন কমল হাসানের কাছে লুকিয়ে আছে। পাতালপুরী খুলেছিল সাত দিন পর।
বাড়ির খড়খড়ির রং সবুজ। রক্তকরবী ফোটে না আর।
বিশু পাগল বিশু পাগল। সেই সকালে দুমুঠো মুড়ি খেয়ে তোমার খিদে পায়নি বিশু পাগল? আহ বকুল ফুলের গন্ধ নাকি

No comments:

Post a Comment