কবিতাগুচ্ছ
মোমবাতি
বাড়ি এবং বাগান মুছে দিতে দিতে
ঠিক তোমার মতো দেখতে একজনের সঙ্গে তোমার দেখা হচ্ছে, যে তোমাকে তোমার ফেলে আসা
শহর, ফেলে আসা গাছ এবং পাখিদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তুমি স্বীকার করছ না এবং তুমি অস্বীকারও করছ না।
একটা মোটা এবং ভিজে ডাস্টার দিয়ে তুমি মুছে যাচ্ছ আর মুছে যাচ্ছ। কাগজ পোড়ার গন্ধ
লেগে যাচ্ছে চামড়ায়। হাওয়া ভারি হয়ে উঠছে এবং ভিজে যাচ্ছে। এবং তুমি জীবনের মত করে
দু অঞ্জলিতে ধরছ সাদামাটা একটা মুখ। তোমার সেই মুখে কিন্তু কোনো উজ্জ্বল হাসি লেগে
থাকবে না এবং চোখের মতো দুটো গভীর আর বেগুনী রঙের গহ্বর তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে।
এই নতুন এবং অজানা শহরে তুমি ধীরে ধীরে এই মুখটাকে ভালোবেসে ফালবে। আর কাটাকুটি
খেলায় ভরে উঠবে এই ঘর। তুমি শূন্যের পক্ষ নিতে পার। তুমি কাটা চিহ্নের পক্ষ নিতে
পার। কিন্তু ততক্ষণে এই ঘর আর ঘর থাকছে না। কতগুলি সাংকেতিক চিহ্ন ভর্তি একটা
ব্ল্যাকবোর্ড হয়ে উঠেছে। একটা মোমবাতির জন্য অপেক্ষা করতে করতে তোমার সুতো ফুরিয়ে
আসছে আর তোমার বলিরেখা ক্রমশই ঘন হয়ে উঠছে। এই অন্ধকার ধীরে ধীরে তোমার মোমবাতি
হয়ে উঠছে
ঘুম
এবং তুমি এই আলোকে ভয় পেতে শুরু
করেছ। কালো এবং দীর্ঘ গাছেদের থেকে কালো এবং উজ্জ্বল একটা আলো তোমাকে ভিজিয়ে
দিচ্ছে আর তুমি পড়ে যাচ্ছ। এভবে পড়ে যেতে যেতে তুমি ছায়া হারিয়ে ফেলছ। এর পরের
দৃশ্যে তুমি চোখ বন্ধ করে ফেলবে এবং তোমার প্রতিরোধ শক্তি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। দরজা
খোলা এবং বন্ধ করার মাঝখানে যেটুকু বাতাস, একটা পর্দার মতো দুলতে শুরু করবে তোমার
সামনে। একটা লোভী এবং মাংসভুক গাছের মতো তুমি এই বাতাসটুকুর জন্যই বসে ছিলে। আর
আয়তক্ষেত্রের ভেতর তোমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। দ্বিতীয় দৃশ্যে তুমি খানিকটা উভচর
প্রাণীদের মতো হয়ে উঠবে আর কালো একটা সমুদ্রের দিকে যেতে চাইবে এবং এবার আর তোমার
দম বন্ধ হয়ে আসবে না। সমুদ্রের ভেতর এবার তুমি নেমে যেতে পারবে। কেন না সময়মতো
তুমি চোখ খুলে ফেলেছ। আর সামগ্রিক ফসফরাস তোমাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। এবার কিছুটা নৌকার
মতো হয়ে যাও দেখবে কালো এই ঢেউয়ের সারির শেষে জমাট এবং সমতল একটা সমুদ্র তোমার
জন্য অপেক্ষা করছে। তৃতীয় দৃশ্যে তোমার আর কোনো ঘরের প্রয়োজন হবে না। একটা মৃদু
এবং হালকা চাদরের মতো তুমি শুয়ে পড়তে পারবে এই সমুদ্রের ওপর আর তোমার যাবতীয়
লোহাগন্ধ শুষে নিয়ে এই জমাট এবং স্থির সমুদ্র তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইবে আর
কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসবে
দাও প্রাণ
১
সবার ভেতরেই একটা করে নদী থাকে
নদীর ভেতর থাকে কথোপকথন
নদী বিনিময়ের দিন মানুষ পাগল হয়
নদী বিনিময়ের দিন চারিদিকে শুধু জোনাকি
জোনাকির ভেতর সাঁতার দিচ্ছে দুজন মানুষ
২
সব কিছু খুলে রেখে তবেই জলের কাছে যেতে হয়
সব কিছু খুলে রেখে তবেই জোনাকির কাছে যেতে হয়
চাপড়ামারিতে যখন বৃষ্টি হচ্ছিল তখন চাঁদ ওর
শাদা জামা খুলে রেখে নেমে গিয়েছিল সল্টলিকে
নুন চাটতে চাটতে চাঁদ সেদিন জঙ্গলমানুষ
গাছে গাছে চাঁদ তখন জোনাকি ঝুলিয়ে দিচ্ছিল
গাছে গাছে চাঁদ তখন সংসার সাজাচ্ছিল
৩
এত মেঘ, এত পাখির ডাক
আমার ভেতরে কোনও ঘর নেই
এত রোদ টাঙানো ঘরের দেয়ালে
দেয়াল কোনও আপত্তি করছে না
আপত্তি করবেই বা কী করে
দেয়ালেরও তো কোনও ঘর নেই
চরৈবেতি চরৈবেতি সারাদিন
মেঘ পেরোনো পাখি পেরোনো
পাখির ডাক অব্দি পৌঁছে গিয়ে
ভাঙতে শুরু করল। জল মাটি
সব ধুয়ে একটা আকাশ লেখা হল
৪
মাথার ভেতর প্রজাপতি ঢুকে গেলে
মানুষ তখন কেবল রঙ লিখতে থাকে
মাথার ভেতর প্রজাপতি ঢুকে গেলে
মানুষ তখন আর আড্ডা দিতে যায় না
তখন আমার বাগানে পাখি ফোটে
তখন আমার বাক্সো-ভর্তি তারার গাছ
তখন একটি দিঘি ঢুকে যায় প্রচ্ছদে
সারাদিন স্নান। সারাদিন
শাপলাফুল
বাগানে তখন তারাদের বনমহোৎসব
৫
সবাই বলবে গোল্লায় গেছে। যাক গোল্লায়
তবু এই বৃষ্টিকাতর রাতে আমি তোমাকেই
আকন্ঠ জড়াব। হে বাসস্টপ
হে অপেক্ষা
ট্রেন চলে যায় উত্তরবঙ্গের দিকে
আমার যাওয়া হল না। চিলাপাতা
ফরেস্টে
গাছ বেয়ে শুধু জল পড়ে। আমার যাওয়া হল না
শুধু এই বৃষ্টিকাতর রাতে আমি আষ্টেপৃষ্ঠে
জড়িয়ে ধরব তোমাকে আর তোমাকে
৬
এক লাইন ঠোঁট লিখতে লিখতে দু লাইন
শরীর লেখা হল। শরীরের
ভেতর যে মেঘ
গর্জন করে উঠল তাকেও লিখলাম
মাঝরাতের হাইওয়েতে একলা ট্যাক্সি
লিখতে লিখতে ঢুকে গেছি ধানের ভেতরে
তুলে ধরেছি মুখ, চুম্বন নেবে না
৭
এক বাতাস প্রেম দু আঁজলা চুম্বন
কয়েক তরঙ্গ কোমল নিষাদ
বুকের ভেতর দিয়ে হেঁটে যায় দামিনী
স্থাপত্যের ধারণা নিয়ে বসে আছি
কিছু কিছু জলের ধারণা
কিছু মাটির প্রস্তাব দেবে তুমি
মাটির ভেতর শুধু গান আর গান
৮
এভাবে ঢেলো না। সেতার বাজছে
মাঝরাতের দরবারি থেকে পৌঁছে যাচ্ছে
আহির ভৈরবে। মাটির ওপর শুধু প্রজাপতি
কতটা হরিণ শিখলে পরে ঘাসবন
কতটা কাজল পার করে চোখ
এভাবে ঢেলো না, আকাশ কাঁপছে
সবুজ শুধু ছুঁয়ে থাকো আমায়
৯।
আরও গহন করে বৃষ্টি বলো
যেন মন্দ্রসপ্তক।চিঠি লেখো
জলের ভাষায়। আমিও জোনাকি
পাঠিয়ে দেব ই-মেলে
এই যে সমুদ্র এসে দঁড়িয়েছে
পিয়ানো কিছুই জানতে পারে না
শুধু বৃষ্টির সোনাটা বেজে যায়
শুধু মোম গলে গলে পড়ে
১০।
একবার তুমি ভেজা ক্যানভাসে
রঙ ঢেলে দাও, দেখবে রঙের
সঙ্গে তুমিও হাঁটছ জলের দিকে
এভাবেই বৃষ্টি আসে ধানখেতে
এভাবেই জলের গল্প শুরু হয়
'দাও প্রাণ' কবিতাটিই সবচেয়ে ভাল লাগল। ৩য় লাইনে 'লদী' শব্দটি কিন্তু পীড়াদায়ক।
ReplyDeleteঅভিভূত!
ReplyDeleteশত-সহস্র স্তুতির ওপরে যদি কিছু থাকে, তবে ওটাই তোমার প্রাপ্য ......
নিজেকে খুব নিঃস্ব লাগে, এত লিখি বা লেখার চেষ্টা করি,কিছুই মনে ধরে না !
তোমার এই লেখাগুলো, বা একটা কবিতার একটা লাইন বুকে এসে লেগে চোখে জল এনে দিল !!!
সংসারে সংসারী সেজে, এ জীবনে অরূপ-রতন অধরাই রয়ে গেল !!!
Mombaati aar Ghum ....... just, what to say !!!! I'm unable to explain !!
ReplyDelete