Wednesday 20 December 2017

চ ন্দ ন ভ ট্টা চা র্য


গদ্য

চ ন্দ ন  ভ ট্টা চা র্য

আর ডিএক্স



হোয়াইট মার্বেল-এ তৈরি শীতল ও শক্ত --- অতীতের সমস্ত গথিক সৌধকে তুমি রাহুল দ্রাবিড় নামে ডাকতে পারো। যেমন আকাশ থেকে টাঙানো ঝাড়-লন্ঠন, যেমন মিউজিয়ামের দুধ-রঙ অন্তর্দেয়ালগুলো --- কিন্তু রাহুল কি ওই প্রাসাদে বসে চতুর্দশ হারেম তার মণিবসানো মণিবন্ধে নাচাতো? না। সে বরং রাজমহলটি বানানোর পর নিজের বুড়ো আঙুলকে টিকটিকির লেজ হয়ে যেতে দেখেছে, যা শরীর-বিচ্ছিন্ন হয়েও লাফাতে ওস্তাদ!

ওপরের স্তবক থেকে দুটো সত্যি পিছলে নেমে আসে। দুর্গের রাজার নাম ভারতীয় ক্রিকেট। আর রাহুলের পক্ষে উত্তরাধিকারী রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। সদ্য নিজের তৈরি কাঁচা রঙের গন্ধ-ওঠা বাড়ির কলিং বেলে যখন হাত রাখে রাজ-মিস্তিরি, তার বডি-ল্যাঙ্গোয়েজ দেখেছ! সিমেন্ট-খসখসে মোটা হাতের চিরুনি দিয়ে মাথার খাড়া কুন্তল সজুত করতে করতে সে বাকি কটা টাকার তাগাদায় এসেছে। তার গামছা-চেক লুঙ্গির আভিজাত্যের কাছে বাড়ির মালিকের তিনশো চব্বিশ টাকার হাওয়াই চপ্পলও থিন অ্যারারুট লাগে।

দুই
তাহলে ৯ই মার্চ দুহাজার বারোতে সৌধ কি স্মৃতিসৌধে বদলে গেল! মোট্টেই না। আর. ডি. চিরকাল এক্স(অতীত)-ই ছিলেন। ব্যাট করতে নামার সময় ক্যামেরায় রাহুলের মুখখানা চোখে পড়েছে আশাকরি। টেস্টের মাঠে মনে হবে, বাবার মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে প্যাড আপ করতে হয়েছে, ওয়ান ডে-র দিনে চলতি ধারণাঃ মা এইমাত্র দেহ রাখলেন, আর টি টোয়েন্টি? ছোট ছেলে আই.সি.ইউ.-তে! আধুনিকতম ক্রিকেটের টিক টোয়েন্টিসেবন করেও রাহুল যে সুস্থ মাথায় অবসর নেওয়ার দিনক্ষণ মেনে সাংবাদিকদের সামনে বসে পড়েন, এই না কত! কাজেই রাহুল দ্রাবিড় হল কবর থেকে ওঠা এক ক্ল্যাসিকাল ভূতের নাম। অথবা, মহেঞ্জোদরোর বাঁহাতে কনুই ইস্তক বালা-পরা নগ্নিকার পুরুষ রেপ্লিকা। বিশ্ব ক্রিকেটে তিনি টাইম মেশিনে চেপে দুটো অধ্যায় পেছন থেকে লাফিয়ে এসে বসেছেন। এখন ব্যাটে-বলে ধোনি-যুবরাজ-পাঠান যেন ইন্দ্রিয়াসক্ত সৌরঝড়ের যুগ। এর আগে ছিল পতৌদি-দুরানি-বিশ্বনাথের রোম্যান্টিক এরা। কিন্তু শুরুতে বল পড়ে, ব্যাট নড়ে কি নড়ে না”-র দমচাপা সুগন্ধে যে ফার্স্ট স্লিপের বাতাস ভারি হয়ে থাকে, তার জন্যে আমরা প্রণাম করলাম জয়সিমা ও গাভাসকার ও রাহুল দ্রাবিড়কে। এরা সমসাময়িক!

এমন স্লান্টিং ব্যাট, যে সামনের পায়ে ঝুঁকে খেললেও বল পিচে এক ড্রপ খেয়ে উইকেটকিপারের হাতে চলে যায়। দেখে আমাদের কী কুলকুলি! শুধু খেলা কেন হবে, জীবনই যেন অনন্ত। টার্গেট আছে, সময়সীমা নেই। বিবাহের সংজ্ঞা হল রাহুল দ্রাবিড় ক্রিজে গেছেন। সন্তানের জন্ম হল রান...বাট হোয়েন উইলিট টেইক প্লেইস! শুধু একের পর এক পুত্রকন্যাহীন ডেলিভারির কোলাভরি-ডি চলছে। আহা, তাড়াহুড়ো করো না। আগে বাসন-ধোয়া, তরকারি-কাটা, মাছের আঁশ ছাড়ানো...তারপর তো উনুনে চাপাবো একটা জোরে পুশ, গ্যাপ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টাকে। হয়তো ছত্রিশটি বন্ধ্যা-বল শেষে স্কোয়্যার লেগ দিয়ে প্রথম সিঙ্গলস পরিবেশন, তারও ছবল পরে থার্ডম্যানে আর এক রান রচনা।

সত্যের যতটা সম্ভব কাছাকাছি ছিলেন তিনি। এবং ততদিনে সত্য অবসোলিট হয়ে গেছে। অথচ মুশকিল, রিটায়ার করার পরেও বেঁচে থাকার মতো, বুড়ো চুলের খুব পুরনো কোনও মানুষ রোব্বারের বাজারে হঠাৎ প্রকাশিত হওয়ার মতো, সত্যের স্লিপ-ডিস্ক ছায়াটা আমাদের টেনশান দিতেই থাকে। এখানে একখানি হাসি পরিবেশন করব। স্কুলবেলায় একটি মেয়ের জন্যে (ছেলে হলে একটালিখতাম...দ্রাবিড় সভ্যতা) আমার হৃদয় কিছু গড়বেতা-কেশপুর করেছিল। গ্রামের পুকুরজলে তাই নিয়ে চ্যাংবাজির হপ-স্টেপ-জাম্পে গুজব ছড়িয়েছিল কি! এইরকম ছোট বিপন্নতার মধ্যে মাঝে-মাঝেই সত্যচরণ পালকে দেখতে পেতাম--- মেয়েটির বাবা--- সাইকেলে গ্যাস আনতে যাচ্ছেন বা বিকেলে পাশের পাড়ায় তাস খেলতে। দেখামাত্র আমার মনে অবধারিত ফিসফিস শুরু হত: সত্য কখনও চাপা থাকে না... ওই দেখো, সত্য ঠিক বেরিয়ে পড়েছে!



তিন
এই পৃথিবীতে কেউ কি কাউকে ইন্টারেস্ট-ফ্রি লোন দেয়, ভগবান ছাড়া? এবং তোমার ঝুপ-ঝুপ করে ঘাম ঝরে চেন্নাইতে মাথা-বুক থেকে, শীতের হাওয়ায় কোলকুঁজো পিঠের ভেতর শনশনিয়ে ঢুকে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। এবং যখন পৃথিবীর দ্রুততম আপেলটা তোমাকেই খেতে চেয়ে ঠোঁটের কান ঘেঁষে শিস কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন ক্রিকেট বোর্ড ক্যারাম খেলে, রেসের মাঠে বসে থাকে স্পনসর আর মিডিয়া মাল-টাল খেয়ে ঘুমিয়ে কাদা। কিন্তু তুমি পালটা মার দিয়ে বেরিয়ে যাও না তো! যেহেতু জেনেছ, প্রতি-আক্রমণ এক রকম পালিয়ে যাওয়াই...ছেষট্টি ফুট পিচ রাস্তায় গড়াতে গড়াতে, মহাত্মার চেয়েও গায়ে বেশি কালশিটে-মার নিয়ে, বস, তুমি বুদ্ধপুত্র --- কালা কানুন”, “সাদা কানুন”, সব জ্বলাকে রাখ করে দাও।

ব্যাটিংসত্য তোমাকে যে সুদহীন ঋণ দিয়েছিল, তারই বলবুতেঁ পরচালিয়ে গেলে, হে উদাসী! আমাদের কোন কাকভোরে জীবিকা খুঁজতে বেরিয়ে যাওয়া জীবনে, আমাদের সেলসম্যান নসিবে দ্রাবিড় রয়েছে। ছুটে বাস ধরা, ঝুঁকি নিয়ে পেরিয়ে যাওয়া রেললাইনের ওপরেই বস্তির রেডিয়োয় রাহুল ৩৭ বা ৪৫ নট আউট। ও-মাল যখন একবার সেট হয়ে গেছে...লে আমরা ব্রাশ মুখে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। হিস্টিরিয়া রুগির দাঁতকপাটি আর দ্রাবিড়ের ডিফেন্স, খোলো দেখি তুমি কতবড়ো পোস্তোর বড়া!

দর্জির কাঁচি দিয়ে সাঁই করে টেরিকটন দুভাগে কেটে ফেলা--- দ্রাবিড়ের কভার ড্রাইভ। আর আহা, ওই আছে-কি-নেই-কোমর মোচড়ানো কৌণিক পুল-এর আবেগ, লজ্জায় লিপস্টিক-লাল ভাবতেই পারিনিছক্কাগুলো। যেভাবে টি টোয়েন্টির নাইট ক্লাবে সব কটা বাউন্সারকে নামালেন পায়ের কাছে, তাতে মনে হবেই, ক্ল্যাসিক ছাড়া এ-জীবনে অন্য কিছুর ধোঁয়া ছাড়েননি, এবং গানওনি রবীন্দ্র বাদে অন্য কাউকে --- যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্ব-রানে

তোমার জন্যেই ছিল আমাদের লম্বা ঘাসে কিশোর-পা ডুবিয়ে বাউন্ডারিতে দাঁড়ানো, পেছনে পুকুর। দুপুরের ঝামা রোদে যখন ভুরু গলে গিয়ে নিজের ঠোঁটটাকে সামুদ্রিক ঝিনুক করে তুলেছে, একটা ছিটকে আসা ক্যাচের সাধনা তোমার জন্যেই, হে রাহুল। দেরিতে ভাঙা ইনস্যুইংগার ভয়ে ভয়ে ফ্রন্টফুটে যাওয়া গরীব ছেলের অরক্ষিত পায়ে পড়ে তাকে দোলের বেলুনের মতো ফাটিয়ে দিত আর সেই স্বেচ্ছা-রক্তদান শিবিরে তোমারই মুখ ভাসিয়ে রাখতাম মোরা সকলে।

টেকনিক্যালি বলতে গেলে রাহুল মানে সতর্ক আর দ্রাবিড় সাহসী ( আমার ব্যক্তিগত ডিকশনারির প্রথম পাতায় পাবেন। যেমন বীরেন্দ্র ছিল চলাও বল্লাআর সহবাগ ভাবতে বয়ে গেছে”)। এখন ডাকাবুকো লোক কি সাবধানী হয়, প্রশ্নটা সেমিনারের বিষয় হতে পারে। এবং এই যে কন্ট্রাডিকশান ইন টার্মস, ইহার কারণেই রাহুলের চোখ-মুখ সদা-ঘোলাটে। যেহেতু আত্মগোপনের দু-নম্বর নামও রাহুল দ্রাবিড়।

স্বপ্নে আমাকে অনেকবার তার ইন্টারভিউ নিতে হয়েছে। সব সময়েই কিছু না কয়ে সামনে দিয়ে সাদা ব্যাট হাতে হেঁটে চলে যেত --- সালভাদোর দালি। একবার শুধু একটা প্যারা দিয়ে বলে, ঘুম থেকে উঠেই লিখে ফেলিস কিন্তু:

আমার কাছে যে-কোনও খোলা মাঠই ক্রিকেট। তার শিশির-শিবির ঘাসগুলো, সেখানে শুয়ে সামান্য ফ্রি হ্যান্ড, প্যাডের ফিতে বাঁধা --- সব কিছুই। আমার কাছে সারাদিন রোদে ঝামা-পোড়া হয়ে ফেরার পর মার ভার মুখটাই স্কোরবোর্ড, ভিন রাজ্যে ক্যাম্পে যাওয়ার সময় ওই চোখের ছলছলানি ছুঁয়ে ক্রিকেট ম্যাগাজিনের ছবিগুলো আরও বেশি রক্তমাংস। প্লেনে এক দেশ থেকে অন্য দেশে উড়ে যাওয়া ঘুমের মধ্যে মেঘের শরীরে লেগে থাকে আমার স্কোয়্যার কাট... আমার প্রেম, সন্তানের মুখ, সব ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভে আঁকা।"
এক মিনিট পজ দিলেন রাহুল।
"ক্রিকেট সাত অক্ষরের। হেভেন তার চেয়ে একটা কম....."


No comments:

Post a Comment