Friday 22 December 2017

বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য

আলবাট্রস

শীতের রাতের একটি ট্রেন থেকে নেমে পড়ি মাঝেরহাট স্টেশনে এবং, আমার সঙ্গে নেমে পড়ে সেও এই প্রথম শীতে সে পরে আছে টুইডের খসখসে একটি কোট। কোটের নেকড়ে রঙটি মিলিয়ে গিয়েছে তার গায়ের তামাটে ময়লা রঙের সঙ্গে। তার চুল কোঁকড়ানো গলার কাছে কী এক কারণে জানি একটি সাদা মোটা ব্যান্ডেজ লাগানো স্টেশনে তেমন কেউ নেই ঘটঘট শব্দ করতে করতে কামরাগুলো নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই যেন স্টেশন ছেড়ে চলে গেল সে স্টেশন থেকে বেরিয়ে পশ্চিমমুখো ধুলোমাখা পথটির দিকে একভাবে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ পথের উপর আগাগোড়া বিছিয়ে আছে সাদা ধুলো, তার উপর ল্যাম্পপোস্টের আলো একটি ম্যাটাডোর চলে গেল তার মধ্যে দিয়ে কিছু ধুলো উড়ে গিয়ে বাতাসের ভাঁজে ভাঁজে মিশে ম্যাটাডোরটির সঙ্গেই এগিয়ে চলল তার পর ওই প্রজাপতির ডানার মতো খাঁজকাটা রাস্তাটির একটু উপর দিয়ে, যে রাস্তা আদতে মিশে গিয়েছে
মহাকাব্যের পাতায় সে একটি বিড়ি ধরাল নিশ্চিন্তে বিড়িটি টানতে টানতে মন দিয়ে সে দেখল ল্যাম্পপোস্টের গায়ে সেঁটে থাকা বক্রলিঙ্গ ও শীঘ্রপতনের বিজ্ঞাপনটি ল্যাম্পপোস্টের পাশের দেওয়ালটিতে বড়ো বড়ো করে লেখা- সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে...সেই লেখার পাশে একটি চায়ের দোকান। এখন বন্ধ বিড়িটি শেষ করে সেই বন্ধ চায়ের দোকানের দিকে চেয়ে একটি
আপশোসের থুতু ফেলে বিপন্ন বিস্ময়ে ভরা চ্যাপ্টা মুখটি নিয়ে সে তারপর ঘুরে দাঁড়াল আমার দিকে

"
যাবেন তো?!"... কথাটি বলে সে আর দাঁড়ায় না এগিয়ে চলে আমি তাকে অনুসরণ করি কেবল আমাদের সামনে আলোড়িত ভিড় যেখানে মানুষ বেঁচে থাকেজন্মায়, মরে যায় তাদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি আমি তারাও দেখে তাকিয়ে তাকিয়ে আমায় কারও কারও গায়ের সঙ্গে ছোঁয়া লেগে গেলে চমকে উঠি মনে হয়, শীতঘুম-রত কোনও কালাচের স্পর্শ... সে অবশ্য নিস্পৃহ, আক্রোশমুগ্ধরাজকীয় এক ভঙ্গিতে হেঁটে চলে খুবই আনমনে হাতের চামড়ার ফোলিও ব্যাগটা দোলাতে দোলাতে সে হেঁটেই চলে যেন এই শহরের জনমনিষ্যিকেও সে চেনে না

মিনিট কুড়ি বাদে আমরা এসে দাঁড়াই একটি থানার সামনের ফুটপাথে দুজন পুলিশ থানার সিঁড়ির মুখটায় দাঁড়িয়ে আছে রাইফেলটি হাঁটুর ওপর রেখে গল্পগুজব করছিল তারা আমাদের দেখে থেমে গেল তাদের টুপিটা ভুরু অবধি নামানো আমি আর সে তারপর সরে এলাম থানার গেটের মুখটি থেকে গেটের
বাঁ-পাশে সার দিয়ে দাঁড় করানো রয়েছে বহু গাড়ি তোবড়ানো অটো, পোড়া বাসের ধ্বংসাবশেষ, পরিষ্কার অ্যাম্বাসেডর- সামনে কেবল একটু রক্তের দাগসবকটি কাচ ভাঙা টাটা সুমো... তাদের শরীরে বিশ্রী শুকনো ধুলো সমস্ত স্মৃতিকাতরতা নিয়ে এলিয়ে আছে বিকটভাবে থানার সামনের বড়োরাস্তাটির এপাশে ওপাশে যতদূর চোখ যায়, কোনও যানবাহন নেই কী আশ্চর্য! রাস্তাটি যেন মরে গিয়েছে! মরে ভূত হয়ে গিয়েছে! মৃদুশব্দে জল বয়ে যাচ্ছিল অদূরেই
কোথাও একটা চামড়ার ফোলিও ব্যাগটি খুলে টর্চ বের করে সে মোটা টর্চ। একটি গাড়ির ওপর টর্চের আলো ফেলে সে গাড়িটি একটি ম্যাটাডোর সামনেটা সম্পূর্ণ ভাঙা একেবারে আত্মভুক ছিন্নমস্তা

"
এটি দেখে কী মনে হচ্ছে আপনার?" সে প্রশ্ন করে

ম্যাটাডোরটিকে টর্চের আলোয় ভালো করে দেখতে থাকি আমি তার ধুলোয় ঢাকা নম্বরপ্লেটটি কালো হয়ে গিয়ে বেঁকে রয়েছে মাটির সঙ্গে অনুভূমিকভাবে। দেখে মনে হয়, জোরে হাওয়া দিলে, এখনওএই অবস্থাতেও মাটিকে ছুঁয়ে আসতে পারে সে কোনও কোনওদিন কোন পথে ছিল এই ম্যাটাডোরটি দুর্ঘটনা ঘটার সময়কী ভাবছিল চালকটি দুর্ঘটনা ঘটার ঠিক আগের মুহূর্তে? আদৌ কি ছিল সে তখন
গাড়িতে? নাকি, গাড়ি থামিয়ে খালাসিকে নিয়ে নেমে পড়েছিল কোনও ভাতের হোটেলে, ফুলকপি দিয়ে রান্না করা কইমাছের ঝোল খাবে বলে? খেতে খেতেই কি দেখেছিল এই দুর্ঘটনাটিকে? দেখেছিল কি এই অসহায় ভঙ্গুর অবস্থায় পড়ে থাকতে তার ম্যাটাডোর, যার গায়ে পেনসিল দিয়ে কে লিখে রেখেছে
'
বাবাই+মনা'?  নাকি, দুর্ঘটনার সময় সেও ছিল ম্যাটাডোরটির ভিতর? কী ভাবছিল সে তখন? ঘরে ফিরছিল কি?...বড়োরাস্তা থেকে আলোর কাঠি এসে পড়ছে এই গাড়িগুলোর গায়ে তাতেই তারপর দেখতে পেলাম, ভাঙা ম্যাটাডোরটি মাটির সঙ্গে একেবারে মিশে যেতে যেতে একটুর জন্য থেমে গেল যেখানে, সেখানেই
গজিয়ে উঠেছে কিছু ঘাস আমি তারপর তাকে বলি- আমার খুব ফুলকপি দিয়ে রান্না করা বড়ো কইমাছের ঝোলের কথা মনে পড়ছে আর কিছু না...

আপনি এদিকে আসুন অটোটিকে দেখুন সে আবার আমাকে কথাটি বলে টর্চটি হাতে তুলে দেয় যেন বলে, এসো কমরেড! সমস্ত তৃষ্ণাকে আজ উড়িয়ে দিই হাওয়ায়...

অটোর ইতিহাসটি ঢাকা পড়েছে অন্ধকারের কালো চুলে সময়ের বৃক্ষটি অদ্ভুত নির্মম হয়ে বেরিয়ে এসেছে তার পেট থেকে -কালবেলায় সঙ্গীহীন দৃষ্টিহীন আমি,চতুর্দিকে অন্ধকার তার ভিতরে দাঁড়িয়েই একটি পুজোর জামার কথা মনে পড়ে এই দোমড়ানো অটোতে করেই পুজোর জামা কিনে ফিরছিল কেউ বা কারা বাসে
চাপা দিয়ে দেয় তাদের সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর জামাকাপড় এখন কঙ্কালের তরলিত স্তূপ মৃত্যুর ঠিক আগে আগে মৃত্যুকে মুখে নিয়ে একটি কাক এসে বসেছিল কি অটোর মাথায়? মৃত্যুর পরেও কি সে বসেছিল এখানে? দলাপাকানো জড়ত্বে শেষ প্রাণ হয়ে? অন্তহীন বেদনায় নীল লীন হয়ে যেতে যেতে একটি কাকের কথা মনে পড়ে খুব সে কি এখনও এই অটোর চালে বসে আমাদের দেখে যাচ্ছে একদৃষ্টিতে? যেমনভাবে, আমরা দেখছি অটোকে এবং অটোটাও দেখছে আমাদের?... মনে পড়ে এক বাবার কথা যে ছেলের জন্য শখ করে কিনে আনছিল জামা ও হাফপ্যান্ট...

"
আমার দুর্গাপুজোর কথা মনে পড়ছে নতুন জামার কথা মনে পড়ছে"...এমনটাই তাকে বলি আমি

সে তারপর আমাকে নিয়ে যায় পুড়ে যাওয়া বাসটির কাছে...ওই জায়গাটায় গিয়ে আমার মনে পড়ে লেবু লজেন্সের কথা পাঁচটাকায় এক প্যাকেট

এভাবেই প্রতিটি রাতেই শহরের বিভিন্ন থানার সামনে দাঁড়িয়ে থানার পাশে রেখে দেওয়া গাড়িগুলোর কাছাকাছি পৌঁছে যাই আমি আর সে কখনও সে টর্চ মারে আমি বলি কখনও আমি টর্চ মারি সে বলে যায়...ভূমিকাটি একই থাকে। মানুষেরই বদলাবদলি হয়ে যায় কেবল এভাবেই চলে আসছে বহুদিন মৃত ক্লিন্ন নেশাচ্ছন্ন গাড়িগুলোর শেষতম দুই বন্ধু  হিসাবেই আমরা ঘুরে বেড়াই শহরের
এপাশে ওপাশে শীতের বিকারগ্রস্ত রাতের ভিতর তারপর সে আর  আমি মিশে যাই কইমাছের ঝোল পুজোর জামা নিয়ে...

No comments:

Post a Comment