Wednesday 20 December 2017

জ য় ন্ত ভ ট্টা চা র্য

গল্প

জ য় ন্ত   ভ ট্টা চা র্য 

জীবন যেরকম

                       

আকাশে জীবনের ছন্দ
বাতাসে মুক্তির গন্ধ
ঘাস আর ইঁটের মাঝে
শ্রমসংগীতের তালে ঝংকৃত
সমস্ত মানবসন্তান
সমস্ত শহীদের
হাতে হাতে বদল হওয়া
অনিঃশেষ মশাল
এরকম সব হাবিজাবি লিখতে লিখতে, অর্থহীন আঁকিবুকি করতে করতে সুগত আজ তীব্রভাবে ভাবছিল দ্রোণাচার্য ঘোষের কথা। আরো কতশত অবান্তর কথা। মনে পড়ছিল ওর বড়ো প্রিয় লাইনগুলো
চেয়ে দেখো মায়কোভস্কি হিকমেত্ নেরুদা আরাঁগ এলুয়ার
তোমাদের কবিতাকে আমরা হেরে যেতে দিই নি
বরং সারাটা দেশ জুড়ে নোতুন একটা মহাকাব্য লেখবার চেষ্টা চলছে
গেরিলা ছন্দে রচিত হতে চলেছে সকল অলংকার
……
আমার বিনাশ নেই
বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসবো
আমার বিনাশ নেই

এ অব্দি ভেবে সুগত নিজের ওপর সুতীক্ষ্ণ শ্লেষে হেসে ফেললো। এ সবগুলোই হবার কথা ছিলো। কিন্তু ওর জীবনে হয়নি, বা আরো ঠিকভাবে বললে হতে পারেনি। সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসতে চেয়েও পারেনি, বিনাশ হয়েছে “ন হন্যতে হন্যমান”-এর। ওর মনে পড়ে গেলো কর্ষিকার কথা। না পড়লেও চলতো। স্মৃতির সিঁড়িগুলো বেয়ে ধাপে ধাপে উঠে আসছে একের পরে এক চলচ্ছবি, পরের পর আখ্যান – অনিরুদ্ধ লাভাস্রোতের মতো। এখনকার ভাষায় নয়, ভঙ্গিমায় নয়, শব্দে নয়, অনুভবেও নয় – এ এক অন্য সময়ের রূপকল্প, অন্য আভাস, অন্য জীবনের জলছবি। ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে, আবার টুকরোগুলো জুড়ছে, আবার ভাঙ্গছে। আরব্যরজনীর দৈত্যের আঙ্গুল গলে বেরিয়ে যাওয়া জিনের মতো। জানু পেতে বসে আঁজলা ভরে যদি তোলা যায়!

--- “মা, আজকের প্রোগ্রামটা যা সুন্দর হয়েছিল না, একেবারে গুজু! চারপাশে মানুষ থিকথিক করছিল। নাটকটা যখন শেষ হচ্ছে আমাদের ঘিরে তখন অন্তত চার-পাঁচশো মানুষ। একটা বৃত্ত, দুটো বৃত্ত ….. সাত আটটা বৃত্ত তো বটেই। এতগুলো বৃত্ত জুড়ে শুধু মানুষের মাথা। তুমি যদি দেখতে! কোত্থেকে আবার একটা পুলিসের ভ্যানও এসে দাঁড়িয়েছিল। ওদের সামনেই তো নাটকের শেষ কোরাসটা করলাম সবাই মিলে।”

কর্ষিকা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললো হুড়মুড় করে। একসাথেই বাড়িতে ঢুকেছিল সুগত আর কর্ষিকা। সুগত ছোট্ট করে ওর হাতে চাপ দিল। ও চায় না কর্ষিকা পুলিসের প্রসঙ্গ ওর মার সামনে তোলে। এমনিতেই কলেজ, নিজের বাড়ির চেনা ছন্দ, এতদিনের লালিত অভ্যেস যখন তখন বাদ দিয়ে কর্ষিকার এভাবে প্রোগ্রাম করে বেড়ানোতে ওর মার আপত্তি রয়েছে। অস্বাভাবিকও নয়। স্বামী হারানো সাধারণ স্কুল শিক্ষয়িত্রী। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে সংসার, ওকে নিয়ে বেঁচে থাকা, ভবিষ্যৎ নিয়ে যাকিছু স্বপ্ন দেখা। এর মাঝে আজকের প্রোগ্রাম নিয়ে পুলিসের এই প্রসঙ্গ অহেতুক ঝামেলা বাড়াতে পারে।

--- “কি হবে মাকে বললে? তুমি মাকে বড্ডো ছোট করে ভাবো। পুলিস ছিলতো ছিল, বেশ হয়েছে। ওদের সামনেই তো তুমি কাশীপুর-বরানগরের কথা বললে। সবার শেষে তুমিই তো বললে – আমরা আমাদের নাটকের এই জায়গাটা ফাঁকা করে দিচ্ছি। যারা বুক চিতিয়ে আগামীদিনে এগোতে পারবেন তাদের জন্য, সেই অনাগত ভবিষ্যতের জন্য খোলা রইল এই মঞ্চ।”

কর্ষিকা ফোঁস করে উঠলো। সুগত বেগতিক দেখে চুপ। একটু বিরক্তি আর অস্বস্তিও বোধহয় ফুটে উঠেছিল মুখে। সোজাসুজি তাকিয়ে মুখটা এতটুকু হয়ে গেল কর্ষিকার। ওর ধরনটাই এরকম। আবেগপ্রবণ, ছটফটে, খেয়ালি বেশ খানিকটা। চারপাশের জমি-বাড়ি-তত্ত্ব–তালাশের হিসেবের খোঁজ রাখেনা, জীবনের চওড়া আঙ্গিনায় মেপে মেপে পা ফেলতে শেখেনি এখনও। ও সেসব মানুষের দলে পড়ে যারা সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চায় সবকিছু আগুপেছুর ভাবনা না ভেবে। আর সেসব মুহূর্তে কোন বিরোধিতা সইবেনা, বোধহয় সইতে পারেনা। খেপে যায়। যা মনে আসে বলে দেয় কোন রাখঢাক না রেখে। এ আচরণ অনেকের কাছেই আঘাত হয়ে আসে যেমনটা ঘটেই থাকে মানুষটির ভেতরের কুলুঙ্গিখানা দেখতে না পেলে। এসব আচরণের পরমুহূর্তে আবার কর্ষিকা কেঁদে ফেলে নিজেকে অপরাধী ভেবে। এসব নিয়েই ও – মনে হয় একটা সাদা ক্যানভাসে বিভিন্ন অনুভূতির রংবেরঙের ছোপ। ভ্যান গগের ছবির মতো হয়তো খানিকটা।

সুগত যা আশঙ্কা করেছিল সেটাই ঘটলো। ওর মা টিভির দিকে তাকিয়ে বা না তাকিয়ে, শুধুই অন্যদিকে তাকিয়ে,  বলে উঠলেন – “কেন যে ওকে এ পথে নামালে! আমার ভয় করে খুব। অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে। কখন কি ঘটে যাবে। পড়াশুনো মাথায় উঠেছে। শরীরেও তো এই ছিরি। আমার এসব একদম ভাল্লাগে না, সুগত।”

এক অদ্ভুত অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। চারপাশের বাতাস হঠাৎ যেন থম মেরে গেল। কেউ কোন কথা খুঁজে পাচ্ছেনা। কর্ষিকার কুঁকড়ে যাওয়া মুখ। বুকে তিরতির করে এক যন্ত্রণা শুরু হয় সুগতর। কে বোঝাবে মেয়েটাকে সব কথা সব জায়গায় বলা যায়না, বলতে নেই। থমথমে পরিবেশটা একটু হালকা করতে সুগত কথা শুরু করে –
---“মাসীমা, আরো সবাইতো আছে। একা তো নয় ও। কেউ তো এগোবে, প্রথমে পা ফেলতে হবে কাউকে তো। ও না হয় পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা না দেখে, তুমুল আড্ডা না দিয়ে নতুন সাথীদের নিয়ে কিছু একটা গড়ে তুলতে চাইছে। বলুন খুব খারাপ কিছু কি করছে?”
---“রাখো তোমার ওসব পুরনো কথা। এগুলো কি আর শুনিনি? নতুন শুনছি? আমার একটা মাত্র মেয়ে। ওকে নিয়েই তো আমার জগৎ। এখানে আমি খুব স্বার্থপর। সব বুঝেও পারিনা। বুক কাঁপে। তুমি বলো, পরিবর্তন করা যদি এত সরল একটা ব্যাপার, সহজ একটা বিষয় হবে তো তুমি ফিরে এলে কেন?”

সুগত ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে মাথা নীচু করে। সত্যিই তো ও ফিরে এল কেন? কি উত্তর আছে এই মর্মভেদী প্রশ্নের। অপার্থিব এক শূণ্যতা ঘুরপাক খাচ্ছে বুকের ভেতরে। ভদ্রমহিলা নিজের অজান্তে সুগতর হৃদয়ের প্রলেপ দিয়ে রাখা ক্ষতের ঢাকনাটা একটানে সরিয়ে দিয়েছেন। গলগল করে ঝলকে ঝলকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। কেউ দেখতে পাচ্ছেনা, কিচ্ছুটি বুঝতে পারছেনা বুকের ভেতরে রক্তনদী বইছে। স্মৃতির টুকরোগুলো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ওর ওপরে। এলোমেলো করে দিতে শুরু করল সবকিছু।




অন্যসব কমরেডরা বেরিয়ে গেছে। একজন কমরেডের জন্য অপেক্ষা করছিল সুগত। একটা নতুন অঞ্চলে যাবে কমরেডটিকে নিয়ে। বড্ডো দেরী করছে ছেলেটি! কি হল? এইসময় বাইরে এসে নিঃশব্দে জিপটা দাঁড়ালো। জিপের দরজা খোলার আওয়াজ যখন শুনলো তখন বড়ো দেরী হয়ে গেছে। দুজন অফিসার খোলা রিভলভার নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলো। বাড়িটা পুলিস ঘিরে ফেলেছে। তারপর সব রাশি রাশি দুঃস্বপ্নের মতো। থানায় নিয়ে “আদর” শুরু হয়েছিল। কতক্ষণ? এখন আর সময়ের হিসেব মনে পড়েনা। ঐ বাড়ির প্রতিবন্ধী ছেলেটির পক্ষাঘাতে দুর্বল দুটো হাত ভয়ঙ্করভাবে মুচড়ে দিচ্ছিল একজন পুলিস।

---“তুমি মুখ না খুললে কনুই থেকে ওর হাত ছিঁড়ে নেব!” সুগতকে উদ্দেশ্য করে হিসহিসিয়ে বলল পুলিস অফিসারটি। এগুলোও মনে হয় তখন খুব বড় ব্যাপার ছিলনা। এ ধরণের পরিস্থিতি আসতে পারে সে মানসিক প্রস্তুতি তো ছিল সুগতর। কিন্তু ঝুলিয়ে পেটানোর সময়ে (মনে হচ্ছিল অনন্ত সময়কাল ধরে চলছে) পায়ে মারা প্রতিটি আঘাত মাথায় গিয়ে জোরে জোরে আঘাত করছিল। মনে হচ্ছিল মাথাও ফেটে যাবে। হঠাৎ করেই ভেঙ্গে গেল ও। সেরকম কোন স্পষ্ট কারণ ছিল সুগত? কত কমরেড তো হাত-পা ভেঙ্গে দেবার পরেও মুখ খোলেনি। ওর মনে পড়ে একটা সময়ের পরে শরীরে ক্রমাগত ভারী লাঠির আঘাত আর সহ্য করতে পারছিলনা। আচমকা মরার ভয় চেপে ধরেছিল। শুধুই মরার ভয়? না বোধহয়। মনে হচ্ছিল হাঁটুতে, পায়ে, হাতে ক্রমাগত এ লাঠির আঘাত কোনদিন বুঝি শেষ হবেনা। মুখের ওপরে, ভ্রুর পাশে এসে পড়ছিল শক্তিশালী ঘুষি। একটা সময়ে তোমার মনে হয়েছিল সুগত কিছু খবর দিলে তুমি বেঁচে যাবে, নিস্তার পাবে এই নারকীয় অত্যাচার থেকে। অন্তত এর পরে জেলে গিয়ে নিশ্চিন্তে থাকবে। পার্টি সংগঠনে কিছু চিড় ধরছিল। তোমার আবার পার্টিতে ফিরে যাবার ইচ্ছেও হারিয়ে যাচ্ছিল। কি হল সেরকম এক বুদ্বুদের মুহূর্তে? তুমি মুখ খুললে। তোমাকে দুটি টেবিলের মাঝখানে ঝুলিয়ে যেভাবে পেটাচ্ছিল সে দড়ি খুলে দিল। তুমি ধপ করে মাটিতে পড়ে গেলে। প্রতিবন্ধী ছেলেটি শূন্য বড়বড় চোখে তোমার দিকে অনিঃশেষ তাকিয়ে ছিল যখন তোমার মুখ থেকে শেল্টারের খবর বেরিয়ে যাচ্ছিল। এখন মনে পড়ে ঐ ছেলেটিকে বড় অবলম্বনহীন মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ওর ছোট্ট ডিঙ্গিখানা ভেসে চলে যাচ্ছে দূরে বহুদূরে। ওর সামান্য সঙ্গতি নিয়ে কিছু বীরকে আশ্রয় দিয়ে এসেছে এতদিন। আর সেই মুহূর্তে? ও দেখল সাহসী মানুষেরা, বীরেরা হারিয়ে যাচ্ছে। ভীড় করছে সাধারণ মানুষের দলে। ছেলেটি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল নিশ্চয়ই, যে বিশ্বাস এতদিন ওর জীবনে নতুন জীবনস্পন্দন এনে দিয়েছিল।

পুলিস লকআপের রুটিন কাজকর্ম মিটে যাবার পরে জেলে চালান হল সুগত। যখন জেলে ঢুকছে তখনও ভ্রুর পাশে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে, রক্ত রয়েছে কষে। পরের দিন বাবা মা এলেন দেখা করতে, পারিভাষিক শব্দ ইন্টারভিউ। মজার কথা হল কোর্টে বুদ্ধিমান, ভদ্র, শিক্ষিত ছেলে হিসেবে আলাদা খাতির পেতে শুরু করল। এমনকি জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরে বসে ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা, সুবিধেবাদী কমিউনিস্ট নেতৃত্বের স্বরূপ, ইংল্যান্ডের ফেবিয়ান চিন্তা-ভাবনা, আমেরিকার সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে মনখোলা মনোজ্ঞ আলোচনা হয়েছে প্রতিটি হাজিরার সময়ে।

বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল – ম্যাজিস্ট্রেট, সুগত আর একজন শিক্ষিত পুলিস অফিসার। পুলিস অফিসার বললে একটু কম বলা হয় – জেলার দায়িত্বে থাকা ডিআইবি অফিসার। সে ভদ্রলোকের আবার শিক্ষার কদর বোঝার ধাত রয়েছে। শুধু একবারই সুগতর সামনে গ্রামের এক সাঁওতাল মহিলা কমরেডকে “খানকির বাচ্চা, _____তলপেট ফাটিয়ে দেব” বলে ফেলেছিল। সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য সামলেও নিয়েছিল। “সবার সাথে একরকম ব্যবহারে কাজ হয়না” – হাসিমুখে সুগতকে বুঝিয়েছিল। সুগতর সাথে বার্নার্ড শ, মার্ক টোয়েন, সতীনাথ ভাদুড়ী নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ বিশ্বসংসারে কথা বলার লোক থাকলে বিষয়ের কি কখনো অভাব ঘটেছে এতাবৎ কালে?

জেলের মধ্যে কদিন বাদেই একটা ছোট্ট ঝামেলা তৈরী হল। সকাল থেকে কয়েদীরা খাদ্যাতীত এবং সহ্যাতীত খাবার বয়কট করেছে – পরিষ্কার কম্বল, ওষুধ আর খাদ্যযোগ্য খাবারের দাবীতে। সুগত ওদের সামনে ছিল। মনে হচ্ছিল কতদিন পরে পাল ছেঁড়া নৌকোর পাল যেন আবার সেলাই হয়েছে। জেলারের ঘরে ওকে নিয়ে গেল কথাবার্তা বলার জন্য। এক কমবয়সী এসডিও সরকারের প্রতিনিধি হয়ে এল। সদ্য আইএএস করা, ট্রেইনি, বাঙ্গালী। মার্জিত, শীলিত আচরণ। হাতজোড় করে সুগতকে অনুরোধ করেছিল অনশন তুলে নেবার জন্য, প্রতিশ্রুতি ছিল সবকটা দাবী মানা হবে। কথা প্রসঙ্গে ত্রৈলোক্যনাথের “জেলে ত্রিশ বছর” নিয়েও আলোচনা হল। অনশন সন্ধের মুখে উঠে গেল।

পরদিন বিকেলে কালো ভ্যান এল জেল গেটে – সুগত আর আরো দুজনকে হাজিরা দিতে নিয়ে যাবে বারাসত কোর্টে। সে কোর্টে হাজিরা আর হয়নি, কোনদিনই হয়নি আর। ওর নতুন ঠিকানা হল সেন্ট্রাল জেল। বৃদ্ধ বাবা-মার পক্ষে অতদূর যাওয়া মুশকিল। ভাই আসে ইন্টারভিউ করতে।

মানুষ যখন নামতে শুরু করে তখন বোধহয় গলন্ত লাভাস্রোত না দেখা পর্যন্ত নেমেই যায়। সুগতও নামতে শুরু করেছে, নামছে। তোষামুদে তেলতেলে ব্যবহার ও তারিয়ে উপভোগ করে। আগে অবশ্য কোনদিন করেনি। ওর চরিত্রের স্বাভাবিক মাধুর্যের জন্য সমস্ত কমরেডের ভালোবাসা পায়। তাই এতদিন পেয়ে এসেছে। কমরেডরা ওর কাছে সৃজনশীল অথচ শক্ত কিছু প্রত্যাশা করে। পার্টি সংগঠনে চিন্তাশীল, ঝকঝকে, সৎ সংগঠক হিসেবে পরিচিত ছিল সুগত। রাজনৈতিক ধারণাও স্বচ্ছ। সাথে ছিল ওর গান – মাঠ ছাপিয়ে মানুষের মাথা ছাপিয়ে ছড়িয়ে যেত, ছুঁয়ে ফেলতো হৃদয়ের আনাচ-কানাচ। শেষের দিকে সুগত বিতর্ক তুলছিল রেডগার্ড অ্যাকশন নিয়ে, পার্টির লেভি তোলার পদ্ধতি নিয়ে, ওদের মতো নেতৃত্বের কমরেডদের যাপিত জীবনের চেহারা নিয়ে। এসবের জন্য অনেকের মাঝেই, অন্তত যারা ভাবে, তাদের মাঝে সংশয় তৈরি হয়। সুগত বোঝে সেকথা। কিন্তু এটাইতো ছিল ওর স্বাতন্ত্র্য চিহ্ন।

সময়টা শীতের শুরু। ওর জেলের সেলে দুদিন পরে আসা কাগজে বইমেলার বিজ্ঞাপন – উন্মনা হয় সুগত। অত ফুরফুরে ছেলেমেয়ে বইমেলায়, কিছু টাকায় ধরে রাখা জ্ঞান। ভেতরটা কেমন শিরশির করে। পাঁচ বছর আগে ও শেষবার গিয়েছিল বইমেলায়। সামান্য কটা টাকার জন্য জ্যাক লন্ডনের “আয়রন হিল” আর হান সুয়িন-এর “দ্য মর্নিং ডিলিউজ” হাতছাড়া হয়েছিল। টাকা থাকবেই বা কি করে? ঐ তো কটা টাকা হাতখরচা সমর্থকদের দেওয়া লেভি থেকে। এর বাইরে আরেকটা অন্যরকম ঘটনা ছিল। মেডিক্যাল কলেজের দুজন বন্ধু কি ভালোবেসেই না মাসে গোটা পঞ্চাশ করে টাকা দিত। ওগুলো আসলে টাকা নয়, এক খাবলা ভালোবাসা।

আবার একা থাকার চিন্তা গ্রাস করছে সুগতকে। আক্ষরিক অর্থে একা। সত্তরের দশকের কমরেডদের জেল কাঁপানো “দাবানল জ্বলুক দাবানল” গাওয়া নেই। কোন কোরাস নেই। জেলের সেলে বন্দী থেকে জেলের শক্তি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ও। স্ব-কে পর করে দিয়ে, ভেঙে ভেঙে গুঁড়ো করে স্বার্থপর করে। কিংবা ঐ ভাঙাচোরা অবস্থায় সামান্য কিছু সুবিধে – মেধা থাকলে বই-পত্র, সাধারণ হলে ভাল খাবার দাবার – দিয়ে নির্বিষ, নির্জীব বানিয়ে ফেলা যায়। এই ঘূর্ণাবর্তের জোর টের পাচ্ছিল সুগত। কিন্তু আবার তলিয়ে যাচ্ছিল বাইরের বাতাস নেবার জন্য সামান্য সুযোগ পেতে। খড়কুটোর মতো স্ব-কে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা আরেকবার করল ও। সে রাতে ল্যাংস্টন হিউজের একটা কবিতার বাংলা অনুবাদ করল। নিজে একটা কবিতাও লিখল অনেক অনেকদিন পরে। কিন্তু পরের দিন কিছু ঘটনাপরম্পরা আবার টেনে নিয়ে চললো ঘূর্ণাবর্তের মাঝে। নানারকম সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে জেল সুপারিন্টেনডেন্টকে একটা চিঠি দেবে ঠিক করে ফেললো। তার একটা খসড়াও দাঁড় করালো। ঝরঝরে সাহিত্যের ইংরেজী। মান সিংহ আকবরকে লিখলে এর চেয়ে বেশী স্তুতি করতে পারত? রামমোহনের ইংরেজ কলেক্টরকে লেখা চিঠির মতো ছিল অনেকটা – সুগত পরে ভেবেছে আর কুঁকড়ে গেছে। কেন করেছিল ও? হোরাশিও, স্বর্গে মর্তে অনেক অদ্ভুত বিষয় আছে যার ব্যাখ্যা মেলেনা। “রাত কত হইল? উত্তর মেলেনা!” একেবারে একা করে ফেলেছে নিজেকে ও। সে ভাঙ্গা সত্তাতেও খবরের কাগজে পড়া ফিলিপাইনসের বা নিকারাগুয়ার লড়ায়ের খবর ওকে একটুখানি চাঙ্গিয়ে দেয়। এই অব্দি!

অবশেষে একসময় জেল থেকে বেরলো সুগত। নতুন ছেলেরা জেল গেটে গিয়েছিল গাড়ি নিয়ে ওকে আনতে। ওদের একজন কথায় কথায় ওর মাকে বলল – “আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে সুগতদার ছবি টাঙ্গিয়ে রাখা উচিৎ মাসীমা।” ক্ষণস্থায়ী তৃপ্তিবোধের এক পাতলা অনুভূতির বাতাস বয়ে গেল সুগতর শরীরে। ভেতরটা কেমন ভরাভরা লাগে। পরমুহূর্তে একটা গনগনে শিক যেন হৃদপিন্ড এফোঁড়ওফোঁড় করে ঝলসে দেয়। তবুও “মানুষ প্রহর জাগে মানুষের মনে” – সুগত বিশ্বাস করে। কোন বারোমাস্যার গীতিকাব্য ঘেন্না করে ওর অস্তিত্বের অভ্যন্তর থেকে। কারণটা যদ্দূর বোঝে এক ক্ষীণস্রোতা জীবনপ্রবাহ এখনও বইছে ওর শরীরে।

এরকম এক সময়ে কলেজে নতুন করে ফিরে এসে আবার ছাত্র সংগঠন আর সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সময়ে পরিচয় কর্ষিকার সাথে। এক ঝলমলে অস্তিত্ব। সবসময়ে ছটফট করছে, কিছু করতে চায়। ওকে ভালোবাসতে গিয়ে সুগত আবার নতুন করে চিনল জীবন, পার্টি জীবনের বাইরে। কর্ষিকার ভালোবাসার উত্তাপে ও টের পাচ্ছিল একটু একটু করে গলে যাচ্ছে। এক নতুন বোধ জন্ম নিচ্ছে – অবয়বটা খুব স্পষ্ট নয়। প্রথম আলাপের সময়ে আরো পাঁচজনের মতো জুলিয়াস ফুচিকের জেলখানার চিঠি নিয়ে ফুচিকের স্বপ্ন নিয়ে কথা বলত ওর সাথে। সাধারারণত একতরফা সুগতই বলে যেত। কর্ষিকা একদিন বলেছিল –“আমার বাবা কল্পনার প্রেমিক পছন্দ হয়না। যাকে স্পর্শ করতে পারি বুঝতে পারি এরকম রক্তমাংসের ভালোবাসার লোক চাই আমি। কেমন হবে সে? কেমন আবার? সূর্যের মতো খাঁটি হবে সে। কি দরকার তোমার ওসব দূরের গল্প বলার? খুব কষ্ট হয়। এই তো তুমি সামনে বসে আছ। তোমাকে দেখতে পাচ্ছি বুঝতে পারছি। তোমাকে নিয়ে তো কোন কষ্ট হয়না। জানিতো তুমি ফুচিক নও। কিন্তু আমার ভালোবাসার মানুষ, আমাকে স্বপ্ন দেখাতে পারে। এর বেশী কিছু চাইনা আমার।”

কর্ষিকা ওর জীবনের পুরোটাই জানে। সুগত সূর্য হবার স্বপ্ন দেখেছিল আবার, স্বপ্ন দেখিয়েছিল কর্ষিকাকে। নতুন নতুন সব ছেলেমেয়েদেরও। তাই নিজের হেরে যাওয়া অন্ধকার হয়ে যাওয়া দিনগুলোর কাহিনী একে একে সব খুলে বলেছিল অকপট সরলতায়। গ্রামের সংগঠনের কথা, দিনের পর দিন না খেয়ে, খোলা আকাশের নীচে রাত কাটানোর কথা। জানিয়েছে নিজের লজ্জাবিধুর পরাভবের ইতিহাস, আবার থানা লক আপ থেকে যেন হিন্দি ফিল্মের চিত্রনাট্যের মতো একক শক্তিতে পালিয়ে যাবার রোমহর্ষক কাহিনী। বলেছে বিএসএফ আর ইএফআর-এর চিরুনি তল্লাশির সময়ে কিভাবে ভূমিহীন কৃষক পরিবার নিজেদের জীবনের বিনিময়ে কমরেডদের রক্ষা করেছে তার অত্যুজ্জ্বল চিত্রমালা। নিজেদের বাঁধন আরো শক্ত হয়ে উঠেছিল। নতুন বন্ধুরা সিনেমার পর্দার মতো ছবিগুলো পরপর দেখতে পাচ্ছিল যেন। ইতিহাসের খন্ডগুলো আলোচনার সময় কখনো নির্লিপ্ত থেকেছে সুগত, কখনো ওর অভ্যন্তর জগতে অজগরের মতো পাক খেয়ে বেরিয়েছে নিজের ওপরে ঘেন্না। অথচ পুরো আলোচনা আবিষ্ট হয়েছে আন্তরিকতার যাদুস্পর্শে। সবকিছুর মাঝে সাতরঙা বর্ণালীর মতো উজ্জ্বল থেকেছে সুগতর অস্তিত্ব। যেন, এই দেখ এতসব করেছি আমি। জয়ের আমি, পরাজয়ের আমি। মধ্যমণি আমি। এগুলো অবশ্য পরের ভাবনা। নিজেকে নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে পরে জেনেছে আরেকবার – “আপনাকে এই আমার জানা ফুরাবে না”।

কর্ষিকার কোথাও একটা খটকা থাকে। ওর আপাত অসংগ্লনতা হুড়োহুড়ির মাঝে ও খোঁজে একটা খাঁটি জীবন। সুগতর সব ভাল। সারাক্ষণ মাথায় নতুন নতুন আইডিয়া। সবার মাঝে আইডিয়াগুলো চারিয়ে দিতে পারে। সবাইকে মাতিয়ে রাখে। ভালোবাসে তারার মতো, বৃষ্টি ফোঁটার মতো। কিন্তু কর্ষিকার মাঝে মাঝে মনে হয় সুগতর বুনটে কোথাও একটা ফাঁক আছে, খুব শক্ত নয়।
সেদিন একটা গানের রিহার্সালের পরে সুগত কর্ষিকাকে জেলের পুরনো খাতাটা দেখতে দিয়েছিল। ল্যাংস্টন হিউজের কবিতার অনুবাদ, নিজের লেখা কবিতা, একটা নাটকও লিখেছিল। সব ছিল ঐ খাতায়, ছিল কিছু টুকরো টাকরা কথাবার্তা, এলোমেলো চিন্তার আঁকিবুকি। খাতাটার শেষ পাতায় চোখ আটকে গেল কর্ষিকার।
___“এই পিটিশনটা তুমি লিখেছিলে?”
___”কোনটা?”
___”এখানে যেটা রয়েছে।”
সুগত পিটিশনটা পড়ে। কেন জানেনা কর্ষিকার কাছ থেকে নিজেকে বাঁচানোর কথা মনে আসে। প্রথমবারের জন্য মৃদু অনৃতভাষণ করে সুগত।
___”বিশ্বাস কর, আমি এটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম!”
___”তুমি আমায় সবকিছু বলেছ এটার কথা বলনি কেন?”
___”পাশের কবিতাটা পড়েছ? আবার বলছি, বিশ্বাস কর ওটার কথা একদম ভুলে গিয়েছিলাম।”
কর্ষিকা স্থির চোখে তাকায় সুগতর দিকে।
___”কি বলতে চাইছ? তুমি এটার কথা ভুলে গেলে কি করে? সরোজ দত্তের কথা বলেছ, ফুচিকের কথা বলেছ। এটার কথা একবারের জন্যও বলো নি কেন? তুমি তো মরে যেতে পারতে। কেন খাতায় এটা রেখে দিলে? আমায় গর্বিত হতে দিলে না কেন? রাজহংসীর মতো?”
কর্ষিকা হঠাৎ করেই চুপ করে যায়। অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। সুগত ওর হাতটা মুঠোর মধ্যে নেয়। আচমকা কর্ষিকা ওর কাঁধের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাঊ হাউ করে কাঁদছে –
___”আমি কি এতই সস্তা? তুমি বলো আর কখনো এমন করবে না? তুমি বলো এটাকে ঘেন্না করো। তুমি তো আমাদের সূর্যের স্বপ্ন দেখিয়েছ, ঋজু হবার মন্ত্র শুনিয়েছ। আমরা বিশ্বাস করেছি। তোমার হাত ধরেছি”
আস্তে আস্তে থেমে যায় কর্ষিকা। পরক্ষণে আবার ডুকরে ওঠে –
___”বলো আর কেউ কখনো এরকম করবে না! আমাদের অনাগত সন্তানেরা কি শিখবে সোনা? বলো আবার খাঁটি সোনা হয়ে যাবে?”
এর কদিন পরের কথা। ওদের সবাই একসঙ্গে বসেছিল। একটা নতুন নাটক নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কিভাবে নাটকটা সবচেয়ে ভাল করে ছাঁটাই শ্রমিকদের মাঝে দেখানো যায় এ নিয়ে বিস্তর মতামত আসছিল, বিতর্ক হচ্ছিল। এর মাঝে কর্ষিকার সেদিনের আবেগের তীব্র অস্থিরতাও স্তিমিত হয়েছে। ও নাটকের দলের নিয়মিত অভিনেতা। ঠিক হল সুগত আর কর্ষিকা দুজনে আগামী নাটকটাকে তৈরী করবে।

এ নাটকটা হবে সদ্য বন্ধ হওয়া একটা কারখানার গেটে। শ্রমিকেরা কারখানা বন্ধ হয়ে যাবার পরে ভিখিরীর মতো হয়ে গেছে। কেউ পরের বাড়ি মজুর খাটে, কেউ সব্জী বিক্রি করে। বাড়ির বৌয়েরা মেয়েরা বাবুদের বাড়িতে ঠিকে কাজ করতে শুরু করেছে। কি অসম্মানের বোঝা ওরা বয়ে চলেছে। এ বিষয়েই নাটক। এ নাটকটা করলে কারখানার সরকারি ইউনিয়ন, স্থানীয় পার্টি সংগঠন আর ভাড়া করা মস্তানদের সাথে ঝামেলা হবার, এমনকি মারপিট হবার, প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ইউনিয়নের নেতারা ওদের পার্টির শ্রমমন্ত্রী আর কারখানা মালিকের সাথে কথা বলে আদ্ধেক মতো শ্রমিককে জোর করে কাজ থেকে বসিয়ে দিয়ে কারখানা খোলার কথা চালাচ্ছে। এজন্য কদিন ধরেই পরিকল্পিতভাবে গণসংগীতের দল নিয়ে এসে কারখানার গেটে গান আর আর স্থানীয়ভাবে মিছিল করেছে সরকারি ইউনিয়নের লোকেরা প্রতিবাদের হাওয়াকে নিজেদের পালে বওয়ানোর জন্য। মহিলা সমিতি থেকেও একটা প্রোগ্রাম করে গেছে। তাই নাটকটা করতে গেলে ঝুঁকি নিতে হবে। এ নিয়েই বিস্তারিত কথা হচ্ছিল সুগতদের নাটকের দলে। আলোচনা যখন চলছে তখন শ্রমিক সংগ্রামের এক পুরনো কাহিনী বলতে গিয়ে সুগত হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ল আপাত ব্যাখ্যাযোগ্য কোন কারণ ছাড়াই। ওর কিছু অতীত স্মৃতি ভিড় করে আসছিল। সে স্মৃতি চুঁইয়ে নামছে চোখের জলের ধারা বেয়ে। সবকথা সবসময় সব জায়গায় বলা যায়না। এখনো গেলনা। সুগতর চোখে জল – সবার কাছে এক অস্বাভাবিক দৃশ্য। সবাই খানিকটা অপ্রস্তুত। একটা অল্পবয়সী ছেলে দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে জানতে চাইল – “কি হয়েছে সুগতদা?”

প্রচুর কথার বুদ্বুদ কাটছে মনে। সুগত ভাবল একবার বলেই ফেলে, “তোরা আমার এই কৃমির মতো অসিত্বকে ঘেন্না করিস। তা নইলে সত্যিকারের দুনিয়া বদলানোর সংগ্রামে থাকা যায়না রে!” কিন্তু কথাগুলো শেষ অব্দি শব্দ হয়ে বাক্য হয়ে এলনা। কথাগুলোর ওজন বড় বেশী ভারী মনে হচ্ছে। বারেবারে মনে হচ্ছিল এটা ধৃষ্টতা হবে। এ ওজনের কথা বলার মানসিক শক্তি ওর নেই। আরেকবার ভাবল জীবনের উজ্জ্বল ইতিহাসের কথা জীবন গড়ার কথা বলবে ওদের সবাইকে। কিন্তু সে মুহূর্তে নিজের কাছেই কথাগুলো বড্ডো বেসুরো শোনাল। ভাল হতে চাওয়ার শুদ্ধ হতে চাওয়ার মধুর যন্ত্রণা একদম হাল্কা হয়ে যাবে। এ যন্ত্রণাকে এখন ও নিজের কাছেই রাখতে চায়। এটা আর সবার নয়, ভাগ করে নেবারও নয়। ও এ মুহূর্তের যন্ত্রণা হারাতে চায় না। “তুমি আবার ভালো হয়ে যাও। সেই আগের মতো” – কর্ষিকার বলা কথাগুলো সুগতকে চেপে ধরছে।

সুগতর টলটলে আয়ত চোখে ক্রমাগত বড় বড় ফোঁটা এসে জমছে। আঃ! কি আনন্দ! ও ধীরে ধীরে ধুয়ে যাচ্ছে। ও আর কোন কথা বলল না। বলবেই না ঠিক করে ফেলেছিল। শুধু খুব নিরুত্তাপ গলায়, আস্তে আস্তে ওর বন্ধুদের ওর অস্তিত্বের সাথীদের ঐ চিঠিটার খুটিনাটি জানাল। আর তারপরেই দমকা আবেগে সমস্ত সংযম ভেঙ্গে কর্ষিকাকে পাশে টেনে নিল সুগত। ওর নরম হাত চেপে ধরে প্রায় অস্ফুট স্বরে বলল – “অনাগত সন্ততিরা অতীতের, আমাদের পিতৃত্বের মিথ্যাচারকে ঘৃণা করতে শিখবে। ওরা জানবে ভালোবাসা মানুষকে খাঁটি করে। মানুষের সাথে থেকে খাঁটি হতে চাইলে তার কোন বয়স নেই, সময় নেই, কোন কাঁটাতাড়ের বেড়া নেই। Ecce homo – ঐ দেখ মানুষ।”
___”তোমার ঐ লাইনগুলো মনে পড়ে? –
    দিগন্তে কারা আমাদের সাড়া পেয়ে
    সাতটি রঙের
       ঘোড়ায় চাপায় জিন।
     তুমি আলো, আমি আঁধারের আল বেয়ে
    আনতে চলেছি লাল টুকটুকে দিন।”
একবার বলবে আমার সঙ্গে? তোরা বলবি আমার সাথে কোরাসে?

ওদের রিহার্সাল আবার শুরু হল। নতুন প্রাণস্পন্দন নিয়ে, একেবারে নতুনভাবেই বলা যায়। হাস্নুহানার স্তবকের মতো একটা হাসি ছড়িয়ে ওর চোখ মুছিয়ে দেয় কর্ষিকা – “কি পাগল! এভাবে কেউ কাঁদে! চলো লাইনগুলো আবার কোরাসে বলি।”

ওদের নাটক খুব ভালোভাবে হয়েছিল। মানুষ এসে, মানে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক, তাদের পরিবারের লোকজন আর পথচলতি মানুষ, ওদের জড়িয়ে ধরেছিল। আবার করার জন্য বারবার করে বলছিল। ছোটখাটো হাঙ্গামা হবার পরিস্থিতি তৈরী হয়েছিল। সামলে নেওয়া গেছে। হাঙ্গামাকারীদের সুরক্ষা দেবার জন্য একটা পুলিস ভ্যানও দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু নাটকের শেষে মধ্যিখানে একটা জায়গা ফাঁকা রেখে ওরা হাতে হাত রেখে মানব শৃঙ্খল তৈরী করল।
সুগত সামনে এগিয়ে গিয়ে হাঙ্গামাকারীদের একজনের কাঁধে হাত রেখে জোরে স্পষ্ট করে বলল – “আমরা আমাদের নাটকের এই জায়গাটা ফাঁকা করে দিচ্ছি। যারা বুক চিতিয়ে আগামীদিনে এগোতে পারবেন তাদের জন্য, সেই অনাগত ভবিষ্যতের জন্য খোলা রইল এই মঞ্চ। আপনারাও আসুন! কে বলতে পারে আপনাদের কেউ, আপনাদের সন্তান-সন্ততিরা এই ফাঁকা জায়গা ভরে দেবার জন্য বীরের মতো এগিয়ে আসবেনা? পারবেন বুকে হাত দিয়ে একথা অস্বীকার করতে?”

ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে গেল ভীড়। শুধু রইল ওরা আর কিছু প্রত্যখাত শ্রমিক যারা আজ আর শ্রমিক নেই, কাজ হারিয়েছে। হারিয়েছে জীবনের দিশাও। আগোছালো এলোমেলো হয়ে রয়েছে জীবন।

এখানে শেষ হলনা সবকিছু। একসময়ে অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠানে কোরাসে গাওয়া “গঙ্গা যদিও মেকং নয়, মেকং তোমায় লালসেলাম” বা “দাবানল জ্বলুক দাবানল”-এর সুরগুলো ক্ষীয়মান হতে হতে দূরে সুদূরে হারিয়ে গেল। হয়তো বা কেঊ কোথাও সেই সুরের খোঁজ পেয়ে বুকে ধরে রাখল। ওরা তার হদিশ পায়নি।
কর্ষিকা মানুষের মাঝে খোঁজ করল একজন পুরুষের, পেয়েও গেল। সুগত নারীর মাঝে খোঁজ করল একজন মানুষের। পেয়েছিল। সেদিনের পরে আর কখনো ওরকম নাটক আর হলনা। জানা গেলনা ঐ ফাঁকা জায়গা ভরে দেবার জন্য সাহসী সন্তানেরা আর এলো কি না।

সুগত এখন আনমনে কখনো কখনো ভাবে এলিয়টের লাইনগুলো –
The lot of man is ceaseless labor,
Or ceaseless idleness, which is still harder,
Or irregular labor, which is not pleasant
তাই কি? এখানেই পরিসমাপ্তি? জীবন যেরকম আর কি!

No comments:

Post a Comment