গদ্য
কু ন্ত ল মু খো পা ধ্যা য়
এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে
এক .
– কবির মৃত্যু হলে কী হয় ?
–কবির জন্ম হয় আর একটি প্রেমিক বিয়োগ হয়
- প্রেমিক বিয়োগ হলে কী হয়
– ভালবাসাবাসিতে কম পড়ে যায়
- এই ভালবাসা কী বিমূর্তের ?
– যে ভালবাসতে জানে , সে সব কিছুকেই ভালবাসতে পারে । তাছাড়া মানুষও তো একটা বিষয় । হ্যাঁ মানুষের শরীর আছে । কিন্তু মন যে নিরাকার !
- কথা ?- কথা দিয়ে কি আসলে বিমূর্ততেই যাই না আমরা ? নৈশব্দকেই তো উদ্ভাসিত করতে চাই । কিন্তু পারি কি ?
– কেন বলছেন স্যর ?
–মানুষ আর একটা মানুষকে কিছু বোঝাতে পেরেছে ? এত কথা বলে সে কিছু বোঝাতে পেরেছে ?
– তাহলে কীভাবে বোঝানো যায় ?
– না বলে
– না বলাটা কীভাবে বোঝানো যায় ? ইঙ্গিতে ?
– ভাষায় ... গানে ... কবিতায় ... ছবিতে ...
-আর একটু বলুন স্যর
– বস্তুজগতের পৃথিবী নিরন্তর একটি ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করছে নিজেকে
– কবির মৃত্যুর সঙ্গে এর সম্পর্ক কী ?
- কবিদের মাধ্যমে সেই ভাষা সঞ্চারিত হয় । একজন কবির বিয়োগ মানেই সেই নিঃশব্দের তর্জনীটি খুঁজে পাওয়ার লোক আরও একটা কমে গেল ।
-কিন্তু কবির মৃত্যু হলেও এখন কি বৃহত্তর সমাজের কিছু আসে যায় ? মসজিদ মোড়ে সেই একই রকম দেখতে পাগলিনী কুঁচকে যাওয়া ব্লাউজ পরে হেঁটে যায় ,সে একইরকম ভুট্টাওয়ালা বীজের উপরে লেবু লাগায়
– কিন্তু একদিন তো ছিল গভীর যোগাযোগ !
– সে তো দেবতারাও বিয়ে করতে চাইতেন মানবীদের ! যাইহোক জীবন তো নিজের মত চলবেই ... কোনও মৃত্যুই তো জীবনের বিকল্প নয়
– কিন্তু কবি তো কোনও সামান্য মানুষ নন , তিনি সময়ের আর সমাজের একটা সন্ধি-মুহূর্তে অবস্থান করেন । তাহলে ?
–তার কারন কবিরা প্রতিদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন । চিত্রকর সম্মন্ধে , গায়কের সম্মন্ধে , কবির সম্মন্ধে মানুষ বলে – ওরা একটা অন্য জগতের মানুষ !
- তার মানে ,এখানেই কি বিচ্ছিন্ন করার কাজটি শুরু হল ? তাহলে কি জায়গাটা আস্তে আস্তে বৃত্তীভূত হয়ে যাচ্ছে স্যর ?
– কীরকম ?
– মানে যারা কবি তাঁরাই কবিতা বুঝবেন , কবিদের বুঝবেন , ছবি আঁকিয়েরাই শুধু বুঝবেন ছবি ...
– কিন্তু গান ?
– গান নিয়ে কিন্তু আমার এই ভাবনা খাটে না
- তার কারন গানের ভিতরে আছে সুর
– কিন্তু যে গান বুদ্ধিদীপ্ত ? সে গান সম্মন্ধে কী বলা যায় ?
– তার শ্রোতা কিন্তু কম । কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে বলছি , স্রষ্টারাই শধু সৃষ্টির দিকে যাবেন , আর সেসব বুঝবেন , এমন ব্যাখাও কি ঠিক হল স্যর ?
– কিছুই ঠিক নয় , আবার বেঠিকও নয়
–তাহলে আমরা এতক্ষণ কী বললাম ? কী ভাবলাম আর আলোচনা করলাম ?
– অনেকটা কি এইরকম
এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে , জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কীনা
দুই .
– ভাই কতদূরে তোমার বাড়ি ?
– সমুদ্রের , জলের ভিতরে
– ভাই তুমি কী ভালোবাসো ?
– স্থির আর টলটলে জলের মধ্যে ঘুঙুরের বল খুলে ফেলতে
– কোথায় যেতে চাও ?
- কোনও অবন্ধনা চুলের মধ্যে মাছ হয়ে যেতে
– তারপর ?
– সোহাগের ভিতরে তার নাকে মুখে ঢুকে পড়তে চাই
– তোমার নাম ?
–লাটিম
–সুতো আছে ? তাকে ছেড়ে দিতে পারো ?
- হাওয়ায় ? হ্যাঁ পারি তো
– ঊড়িয়ে নিয়ে যেতে পারো ?
– আমি ঊড়ে যেতে পারি ঘুরে যেতে পারি , এই পৃথিবীর মতো
– না না আমি বলব সেই বাচ্চা মেয়েটির মতো , যে নাচ করতে চায় কিন্তু ঘুরে ঘুরে যায় , পারে না । আমি লাটিম মনের ভিতরে ঢুকে যাই ...
– কার ? অবন্ধনার ?
– হ্যাঁ আর চুলের সঙ্গে ডাই লাগিয়ে দিই ... সে সকালবেলা গভীর জলের মধ্যে উঠে দেখে তার চুল শ্যাওলার মতো ...
– আর পাখনা , আঁশ কোথায় পাও ? তোমার পেশা কী ,লাটিম ?
– আমি আসলে থিয়েটারের মেক-আপ বয় ; মারমেড বানাই , নেবে ?
তিন .
- কেমন লাগল ?
- কী বলব ? ভালো বললে আপনি বলবেন এড়িয়ে যাওয়া হল , কিন্তু একটা ব্যাপার বলব স্যর ? আপনি কি মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতাটা গদ্যে লিখে দিলেন ?
– কবিতাটা বের করি তাহলে ...
জলে নামার আগে যে চুল খোঁপায় বাঁধা ছিল
তা এখন খুলে গেছে ।
কে খুলে দিল ? জলেরা ? মাছেরা ? নাকি মৃত্যু নিজে ?
অবন্ধনার চুল এখন ঘুমিয়ে পড়বে ।
জল , মাছ , মৃত্যু – যেই হও নাক মুখের মধ্য দিয়ে
ওর ভিতরে ঢোকো ।
ভিতরে কুলকুল করে জলতরঙ্গ বাজাও , খেলা করো
যতক্ষণ ও জেগে আছে ওকে হাসাও , আদর করো
-মনে হয় না মোৎসার্টের পিয়ানো -সিম্ফনি বাজছে ? লোয়ার অকটেভ থেকে আপার অকটেভ ? মনে হয় না অজস্র আঙুল যেন ঢুকে পরছে বালির ভিতরে , বিলি কেটে দিচ্ছে চুল ? কবিতাটা নিয়ে বলতে গিয়ে কি নষ্ট করে ফেললাম একে ?
– না না স্যর তবে এই কবিতাটার বাড়ি কোথায় ?
- অচেতনে , গভীর জলের মধ্যে , টলমলে যে চুল কোমর পর্যন্ত এসে ...
– এসে ?
– তলোয়ার আর রৌদ্রের ভিতরে চলে গেছে ...
– কে লিখেছে ?
– যেই লিখুক কিন্তু এর মধ্যে কি পাস্তেরাল অ্যালেগ্রা শুনতে পাচ্ছেন স্যর ?
চার .
– প্রথমে কী ছিল ?
– হাওয়া
–তারপর ?
– মাটি
– তারপর একটা গাছ পোঁতা হল , বৃষ্টি এলো , মেঘ , গাছের চারিদিকে জল ...
– এরপর অনেক কিছু ... অনেক দিন আর রাত্রিবেলা ভেসে গেল আর নোয়ার নৌকার মতো তৈরি হলো নারী ... দীর্ঘ একটা দীঘি ...সময়ে সেই দিঘিটির জল ছাপিয়ে হলো বরফের একটা সরোবর
– আর সেটা অনেক নদীর উৎস , তার নীচে বরফের পাতলা চাদর ঢাকা নিয়ে শুয়ে আছি আমি
– একটা মেয়ের ভিতরে ?
– হ্যাঁ জন্ম নেব বলে । শুনছি সরোবরকে গল্প বলছে হাওয়া ...এই পৃথিবী আর আমার জন্মের কাহিনী ...
– প্রথমে কী ছিল ?
– অন্ধকার শূন্যতা
– শূন্যতা দিয়ে ঢাকা ছিল আলো ? – হ্যাঁ , তারপর আলো- আলো মাথা মাথার ভিতরে আমি ... চোখ ...খুললাম
-কি দেখলে ?
– দেখলাম অজস্র দাঁত
– আর কী দেখলে ?
– দেখলাম ভয় , কে যেন আঘাত করল আমায়
– তাহলে প্রথমে কী ছিল ?
– একটা আইডিয়া
– তারপর ?
– তারপর একটা গাছ ...এইভাবে আলো , বেবি আলো ...নিভে গেলে হাততালি
– তুমি আসলে কে ?
– আমি স্ক্রিপ্ট রাইটারের অ্যাসিট্যান্ট
– কী লিখছ ?
–রুটি
–আমার মাসাধিক কাল ঋতুর রক্ত নেই , জানো ?
–তুমি কি জন্ম-সম্ভবা ?
– না , মেনোপজ
– তুমি কি হাসতে ভুলে গেছ ?
- একদিন পুরুষই ছিল আমার হাসি আর আনন্দের উৎসমুখ
–প্রথমে কী ছিল তাহলে ?
– একটা বিশাল হলঘর , যেখানে আমরা গমগম করছিলাম
– তারপর অন্ধকারে , হাসির ভিতরে আমরা একে অপরের নাম জানতে চাইলাম
– তোমার নাম কী ?
- আমার নাম স্বাতী । জন্ম নেব বলে ভালবেসেছিলাম
- তারপর ? তারপর ঢেউ , বিদ্যুৎগর্ভ মেঘ
– মেঘের ভিতরে কী দেখলে ?
– দেখলাম ধোঁয়া আগুন আর বিশাল গর্ত চারিদিকে ... মানুষ মাটি দিচ্ছে
– আর কী দেখলে ?
– দেখলাম একটা ছবির মতো জায়গা ; যার নীচে বহমান নদী
– জন্নত ?
– দেখলাম জয়দেব বসু হেঁটে যাচ্ছেন লেনিনের সঙ্গে গল্প করতে করতে
– আর ?
– দেখলাম হুর নিয়ে বসে আছেন কবিরুল ইসলাম
– আর কী দেখলে ?
– দেখলাম একটা কাব্যগ্রন্থ যার উপড়ে শুয়ে আছেন মল্লিকা সেনগুপ্ত
– এঁরা সবাই মারা গেছেন ?
– কেউ কখনও মারা যায় না তো !
– বিচ্ছেদও হয় না কি ?
– পৃথিবীতে কারও সঙ্গে কোনও বিচ্ছেদ নেই
– কীভাবে ?
– যেকোনো মানুষই আর একটা মানুষের কাছে একটা আইডিয়া ... আর আইডিয়া মস্তিস্কে থেকে যায় চিরদিন ... এক স্মৃতি থেকে আরও এক স্মৃতির ভিতরে প্রবাহিত হয় । আইডিয়ার মৃত্যু নেই
–অরুন্ধতী , তুমি নক্ষত্র ? তুমি মারা গেছ ? সুপারনোভায় ?
– না , আমি বেশ্যাদের নিয়ে কাজ করি
–প্রথমে কী ছিলে তাহলে ?
–ছিলাম একটা গাছ , একটা নদী , ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল একটা সাইকেল , দূরে বসেছিল মিকি , আমাদের মিকি মাউস
– যাকে তোমরা আদর করে বাল্মীকি বলো ?
– হ্যাঁ , আর ছিল ক্রৌঞ্চ ক্রৌঞ্চী
– তারপর ?
– জন্ম হল বেদনার
No comments:
Post a Comment