Wednesday 20 December 2017

গৌ ত ম চ ক্র ব র্তী


গল্প

  


       
সে
                               
ধাপে ধাপে স্মৃতিগুলো মুছে যায় । প্রথমে সদ্য পুরনো হওয়া ঘটনাগুলো; তারপর বেছে বেছে অপ্রিয় মানুষগুলোর মুখগুলো, হাতগুলো, অবয়বগুলো...; তাদের কেন্দ্র করে জিইয়ে থাকা চিহ্নগুলো; শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ ও দৃশ্যগুলো...। - অশান্ত ইলেক্ট্রনের মতন তার নিয়ন্ত্রণহীন বোধ অতীতের দিকে ছুটতে থাকে ।
... অফিস কলিগরা, পার্টির দাদারা, বিড়িখেকো জমির দালালেরা, বাড়ির দালালেরা, ঘর বয়ে এসে অপমান করে যাওয়া নিকট আত্মীয়রা... তাদের সমস্ত ক্রিয়া-প্রক্রিয়া নিয়ে আস্তে আস্তে উবে যায় ।
২০১৭, ২০১৬, ২০১৫...২০০০,...১৯৯১..১৯৮৭...১৯৭৯,১৯৭৮...।
সে এই তো চেয়েছিল ! এইভাবেই তো চেয়েছিল । দু হাত তুলে, চোখ বুজে সে খাটের ওপর দাড়িয়ে পড়ে । হাঁ মুখের বাঁ পাশ দিয়ে জিভটাকে অল্প একটু বের করে, সে ভেতর থেকে একটা হালকা গোঙানির শব্দ তুলে আনতে সফল হয় ।
এই কি হলো? ... আঃ! ওই দিকটায় যা ... বসা, বসা ... তোরা ... শিপ্রা তুই এদিকে আয় ... হেসো না , ও দাদু হলো কি গো ? ... উফ!! ...কাপড় তো সব মাথায় তুলে ফেলেছো ! এখানে কোনো দিদিমা নেই ... হি হি হি ...
কতগুলো হাত তাকে ধরে বিছানায় শুয়ে, তার দুটো হাত আর দুটো পা বাঁধতে থাকে । কোমর, পড়ে যাওয়া পেট আর বুকটা চিতিয়ে ওপর দিকে তুলে সে একটা ক্ষীণ প্রতিবাদ করে । পারে না । আরো কতগুলো হাত, আরো কতগুলো আঙুল তার ওপর নেমে আসে। শরীরটাকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে হাত আর আঙুলগুলোকে সে এড়াতে চায় । পারে না । সরু, মোটা, হরেকরকমের কালচে, সাদা, হলদেটে রঙের শুকনো আঙুলগুলো সংখ্যায় বাড়ে, বাড়তে থাকে, বেড়ে চলে ... । ক্রমে দীর্ঘ শরীরটাকে তারা মাছির মতন ঢেকে ফেলে । সে উপলব্ধি করে হাজার হাজার মধ্যমা, অনামিকা, তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের চাপ আর উত্তাপের অসামঞ্জস্যে তার শীর্ণ শরীর ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে ...
... অতএব দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে তিলতিল করে গড়ে ওঠা তার শরীরের কোষগুলো, তাদের চরিত্রের মূল লক্ষণগুলো বজায় রেখেও বৈশিষ্ট্য বদলাতে বাধ্য হয় । কয়েক লহমার জন্য সে তার হাত, পা, পেট, বুক, মেরুদন্ড, চিবুক , ঠোঁট, নাক, মুখ, তার সমস্ত শরীরের এই মিলেমিশে একাকার হয়ে সদ্য হয়ে ওঠা রঙহীন, স্বাদহীন, গন্ধহীন তরল অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারে।তারপর কোন বোধহীন জীবাণুর মতন সে নিজের মধ্যে ডুবে যায় ও বিছানার দু-পাশ আর মাথার দিক দিয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে।জড়ানো অস্ফুট স্বরে সে শুধু বলতে পারে আমার শরীর ... শরীর ।  
ফোঁটা ফোঁটা করে বিছানার চাদর চুইয়ে তখন তার তরল সত্তা তাদের ভেতরেকার অবশিষ্ট স্মৃতি কোন গুলোকে নিয়ে ঘরের মেঝেতে টপটপ শব্দ তুলে আছড়ে পড়ে । বিছানার বাঁদিকে পড়া বিন্দু গুলো একটা আরেকটার সঙ্গে জুড়ে একটা সরু রেখার সৃষ্টি করে আর আস্তে আস্তে গড়াতে শুরু করে । ডানপাশ আর মাথার দিক দিয়ে পড়া ফোঁটাগুলো ঈষৎ ছড়ালেও গড়ায় না । কতকটা তার অলস, উদ্যোগহীন, গা বাঁচানো মনোবৃত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তারা মেঝের ওপর স্থির হয়ে পড়ে থাকে । তাদের নিষ্ক্রিয়, একের-আরেকের থেকে বিচ্ছিন্ন, ভিন্ন ভিন্ন গড়নের টলটলে শরীরগুলোয় কড়িকাঠের আলাদা আলাদা আকারের ছবি ক্ষনিকের জন্য ডুবে গুটিকয়েক স্মৃতিকণা গায়ে মেখে ভেসে ওঠে ।... কতগুলো দৃশ্যের জন্ম হয়।
যেমন অতীতের কোন এক দুপুরে সমুদ্রের পাড়ে সে একা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। নানান ধরনের বিভঙ্গের নড়াচড়া দেখতে দেখতে দেখতে এক সময় অন্ধকার নেমে আসে।
যেমন অতীতের কোন এক সন্ধ্যায় টিভির স্ক্রিনের দিকে সে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।চোখের সামনে চেনা - অচেনা ছায়াগুলো নড়াচড়া করে।অতি পরিচিত শব্দগুলোর বারংবার পুনরাবৃত্তি করে।তার চোখ বুজে আসে ।
যেমন অতীতের কোন এক বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে সে সিগারেট ধরিয়ে পরিচিত অথবা অপরিচিত মানুষের মিছিল দেখতে থাকে । এক সময় সে সতর্কভাবে অন্য রাস্তা ধরে ।
যেমন অতীতের কোন এক ...।
নানান আকারের বিচ্ছিন্ন তরল সত্তাগুলো আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়। ছোট হতে হতে এক সময় তারা হাওয়ায় মিলিয়ে যায় ।
একইসময় বাঁদিক দিয়ে পড়ে সরু রেখা সৃষ্টি করা বিন্দু গুলো ধীরগতিতে সবার অলক্ষে গড়িয়ে চলে । দাবার ছকের চোষট্টি ঘরের মতন সাদা কালো মেঝের ওপর দিয়ে বিন্দুগুলো গড়াতে গড়াতে গড়াতে সবার অগোচরে ধুলোর কণা অথবা কোন নাম-না-জানা এন্টিসেপটিক কিংবা ওষুধের ঝাঁঝালো বা মিষ্টি গন্ধ শরীরে  ধারণ করে এগিয়ে চলে।নিবিড়, গোপন ভালোলাগাগুলো, স্মৃতিগুলো একসঙ্গে আরেকবার জ্বলে ওঠে।
একটা নরম তুলতুলে শরীর যার গড়ন কতকটা তারই মতন, শুয়ে শুয়ে ক্রমাগত হাত পা ছুড়ে চলে । তার শরীরে নরম তুলতুলে হাত পা স্পর্শ করে যায় । সে হেসে ওঠে। একটা শক্ত সুঠাম শরীর যার আকার কতকটা তার মতন, পেছন থেকে বার বার তার জরাগ্রস্থ হাত, পা, পিঠে ধাক্কা দিয়ে যায় । সে ভারসাম্য রাখতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় । সে হেসে ওঠে।
যুবক সে ফ্যাক্টরির শেডে ঢোকে । তাকে তার ইমিডিয়েট বস বিস্তারিত ভাবে বোঝায় । সে ঘাড় নাড়ে । প্রৌঢ় সে এইচ আরের রুমে ঢোকে । এইচ আর অল্প কথায় ভাবলেশহীন ভাবে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে নানান কাগজে সই করতে বলে । সে ঘাড় নাড়ে ।
বহুদিনের লালনে বেড়ে ওঠা ফ্যান্টাসি আর বিকার; কিছু অবৈধ মুহূর্ত, বিয়ের পিঁড়ি, উলু ও বারংবার তর্ক আর ঝগড়ার পরে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা...। - ছবিগুলো একটার পর একটা ভেসে ওঠে আর তারপর নিভে যায় । সরু রেখা ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয় । তারপর উধাও হয়ে যায় ।

হাত আর আঙুলগুলো নিয়ে সরে যাওয়া মানুষগুলো আরেকবার বিছানার চারপাশে জড়ো হয় । সে তাদের স্পর্শ অনুভব করে । তাদের ফিসফিস করে বলে চলা কথাবার্তা আবার শুনতে পায় । সে চোখ বোজে ।

No comments:

Post a Comment